গদখালীর মাঠগুলোতে এখন শোভা পাচ্ছে লিলিয়াম, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকাসহ হরেক রকম ফুল। যেন হাসছে। পয়লা ফাল্গুন ও শহীদ দিবসে এই ‘ফুলের রাজ্যের’ ফুল ব্যবসায়ীরা চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন। তাঁদের মুখের সেই হাসি যেন বাগানে ছড়িয়ে পড়েছে।
ঝিকরগাছার যশোর-বেনাপোল রোডে গদখালী ইউনিয়নের বাজারে বসে এই বাজার। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই চাষি, পাইকার, মজুরের হাঁকডাকে মুখর হয়ে ওঠে যশোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমের গদখালী এলাকার এই ফুলের রাজ্য। আশপাশের গ্রাম থেকে ফুল এনে সেখানে চলে বিকিকিনি।
পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি নাসরীন নাহার বলছিলেন, ‘এবার বসন্তবরণ ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ৩৫ হাজার টাকার লিলিয়াম ফুল বিক্রি করেছি। সামনে আরও এক বিঘা জমিতে লিলিয়াম ফুল চাষের উদ্যোগ নিয়েছি।’
যশোরের গদখালী এলাকার ফুলচাষিরা এবারের পয়লা ফাল্গুনে বসন্তবরণ, ভালবাসা দিবস আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুলের ভালো দাম পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। করোনা অতিমারির মন্দাভাব কাটিয়ে নতুন উদ্যমে ফুলের মাঠ পরিচর্যায় মন দিয়েছেন।
পয়লা বৈশাখে বাংলা বর্ষবরণ, স্বাধীনতা দিবস আর দুই ঈদ ঘিরে ভালো ফুল উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতি চলছে মাঠে মাঠে।
ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের হযরত আলীর ৬৬ শতক জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ রয়েছে। গত তিনটি দিবসে তিনি দুই লাখ টাকার শুধু গোলাপ ফুলই বিক্রি করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হযরত আলী বলেন, ‘ফুলের ভালো দাম পাওয়ায় করোনার দুই বছরের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ খোলা থাকলে পুরোপুরি পুষিয়ে যেত। এবার শুধু গোলাপই বিক্রি করেছি দুই লাখ টাকার। সামনের চারটি দিবস ঘিরে মাঠ পরিচর্যা শুরু করে দিয়েছি।’
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সাবেক সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘মহামারির কারণে আমরা কোনো টার্গেট নির্ধারণ করতে পারছিলাম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেচাকেনা ভালোই হয়েছে। তিনটি দিবস ঘিরে গদখালীতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ফুল পাইকারি বেচাকেনা হয়েছে। এতে সবাই খুব খুশি। গত দুই বছর তো চাষিদের খুব ক্ষতি হয়েছে। ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা করোনার ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে।’
প্রতিদিন সকালে দূরদূরান্ত থেকে ফুল কিনতে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এই মোকামে আসেন। সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে স্তূপ করে সাজানো হয় ফুল। পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে ট্রাক-পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যানে ভরে ফুল পাঠানো হয়।
আবদুর রহিমের ভাষ্য, এখানকার চাষিরা ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ ও দুই ঈদ ঘিরে চাষিরা বাগান সাজাতে শুরু করেছেন। আশা করা যায়, তখনো হয়তো আরও পাঁচ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি হবে। এবারের আবহাওয়া অনুকূলে। এ জন্য উৎপাদন ভালো।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যশোরের আট উপজেলায় ফুলের চাষ হয়। এর মধ্যে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারার প্রায় ৬ হাজার কৃষক ৬৫০ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করেন। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ ফুলের জোগান দিয়ে থাকেন গদখালীর চাষিরা।
পিছিয়ে নেই নারীরাও
পুরুষের পাশাপাশি এই এলাকার অন্তত ২০০ নারী সরাসরি ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত।
পটুয়াপাড়া গ্রামের শাহিদা বেগমের অভাবের সংসার ছিল। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ সংসারের হাল ধরেন তিনি।
২০০০ সালে ৩৩ শতক জমিতে প্রথম গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ করেন। প্রথম বছরের ফুল বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে গোলাপ ফুলের চাষ করেন আরও ৩৩ শতকে। স্বামী তাঁকে সহায়তা করেন। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ফুল চাষের মুনাফার টাকা থেকে ফুল আর সবজি চাষ বাড়িয়েছেন। এখন ২০ বিঘা জমিতে তাঁর চাষাবাদ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ বিঘাতে ফুল, ১ বিঘাতে ঝাউ আর ৯ বিঘাতে ধান-পাটের আবাদ রয়েছে।
ফুল চাষের আয়ের টাকা দিয়ে দোতলা বাড়ি করেছেন। চার বিঘা মাঠের জমি কিনেছেন। বাড়িতে পাঁচটি গরুর একটি খামার তৈরি করেছেন।
লেখাপড়া শিখিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। একটি মাত্র ছেলে তাঁর সঙ্গে চাষের কাজে সহায়তা করেন। স্বামী ঢাকাতে থেকে ফুলের ব্যবসা করছেন।
সাহিদা বেগম বলেন, ‘ফুল চাষ আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এবারের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে তিন লাখের বেশি টাকার ফুল বিক্রি করেছি। ওই লাভের টাকা দিয়ে এবার দুই বিঘা জমিতে চায়না গোলাপের চাষ শুরু করব বলে ঠিক করেছি।’
পানিসারা ফুলচাষি সিআইজি মহিলা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাসরীন নাহার বলেন, ঝিকরগাছা উপজেলায় পুরুষের পাশাপাশি অন্তত ২০০ নারী সরাসরি ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা তাঁদের সংসারে বিরাট অবদান রাখছেন। শুধু সাহিদা বেগম নন; পানিসারা গ্রামের খালেদা বেগম, পটুয়াপাড়ার সেলিনা বেগম, শরীফপুরের মোমেনা বেগম, হারিয়া গ্রামের আলেয়া বেগমের মতো নারীরা ফুল চাষ করে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন।
গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এবারের তিনটি দিবসে গদখালীতে প্রতিটি গোলাপ ১৬ থেকে ১৮ টাকা, লিলিয়াম ১০০, চায়না গোলাপ ২৫ থেকে ৩০, রজনীগন্ধা ১৭ থেকে ১৮, রঙিন গ্লাডিওলাস ২০ থেকে ২২, জারবেরা ১৫ থেকে ২৮, গাঁদা প্রতি হাজার ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, জিপসি ও কামিনী প্রতি আঁটি ১৫০ টাকায় পাইকারি বেচাকেনা হয়েছে। তবে আজ মঙ্গলবার আবার দাম কিছুটা কমে গেছে।
সামনে ২৬ মার্চ এবং বাংলা নববর্ষে আবার ফুলের দাম বাড়ার আশা রয়েছে ফুলচাষিদের।