নতুন গরিবদের কী হবে

করোনায় আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। তাঁদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নতুন কোনো কর্মসূচি নেই।

করোনায় গরিব মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের জীবন ও জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন, অনেকের আয় কমেছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে নতুন করে গরিব হয়ে গেছেন কমবেশি প্রায় আড়াই কোটি মানুষ।

অথচ আগামী বাজেটে এই গরিবদের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ থাকছে না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে মাত্র, যার সঙ্গে নতুন গরিবের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সাধারণত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা

জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখন ১২৩টি এমন কর্মসূচি আছে। আগামী বাজেটে এই কর্মসূচিগুলোই অব্যাহত রাখা হবে। আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে মাত্র আট হাজার কোটি টাকা বেশি।

গত এক বছরে গ্রামের চেয়ে শহরে মানুষ বেশি গরিব হয়েছেন। যেমন আগে সুপারশপে চাকরি করতেন; কিন্তু করোনায় চাকরি হারিয়েছেন। তৈরি পোশাক কারখানায় নির্বাহী পর্যায়েও অনেকে চাকরি হারান। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো চাকরি করতেন, কিন্তু ব্যবসা খারাপ হওয়ায় ছাঁটাইয়ের শিকার হন। এমনকি শহর এলাকায় ছোট ছোট কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থাও করুণ; নিয়মিত বেতন পান না। করোনার আগে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা এই শ্রেণির মানুষের চাকরি হারানোর পাশাপাশি বেতন-ভাতা বা আয় কমেছে। তাঁদের অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন।

ছয় কোটি গরিব

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, করোনার আগে ২০১৯ সাল শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার নেমেছিল ২০ শতাংশে। তখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে গরিব মানুষের সংখ্যা বেশ বেড়েছে। গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়েছে, করোনার সময়ে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। এর মানে, সাড়ে তিন কোটি পুরোনো গরিবের সঙ্গে নতুন আড়াই কোটি গরিব যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গরিবের সংখ্যা ছয় কোটির মতো। নতুন গরিবেরা আগামী বাজেটের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে স্থান পাচ্ছেন না।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শুধু সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে বয়স্ক ভাতা এবং স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা ভাতায়। এই দুটি শ্রেণিতে ১২ লাখ সুবিধাভোগী বাড়বে। বয়স্ক ভাতায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা এবং স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা ভাতায় বরাদ্দ সাড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। আর দুই লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা মাসে ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এই খাতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ বেড়ে সাড়ে হাজার কোটি টাকা হচ্ছে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তাকৌশল দিয়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করা যাবে না। কারণ, কারা কারা চাকরি হারালেন, তাঁদের চিহ্নিত করার মতো সক্ষমতা নেই। তাই তাঁদের কাছে সহায়তাও পৌঁছানো যাবে না। সাময়িকভাবে বিপদে পড়ে অনেক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার গরিব হয়ে গেছে। তারা হাত পাতার মতো মানসিকতায়ও নেই। কিন্তু সরকারকে এমন কৌশল বের করতে হবে, যাতে তাদের কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছানো যায়।

দুই-তৃতীয়াংশ খরচ ১০ কর্মসূচিতে

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যত টাকা খরচ হয়, এর দুই-তৃতীয়াংশ টাকা খরচ হয় মাত্র ১০টি কর্মসূচিতে। ওই ১০টির অন্যতম কর্মসূচি হলো অবসরভোগী সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পেনশন সুবিধা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ), ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট, ওপেন মার্কেট সেল, প্রাথমিক শিক্ষায় উপবৃত্তি, আমার বাড়ি আমার খামার। এই কর্মসূচিগুলো নতুন দরিদ্রদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। আবার এবারের করোনায় শহরের মানুষ তুলনামূলক বেশি গরিব হয়েছেন। তাঁরাই বেশি অরক্ষিত অবস্থায় আছেন। কারণ, শহরের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তায় বিশেষায়িত কর্মসূচি নেই বললেই চলে।

বাজেটে কী হচ্ছে

ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করতে চায় সরকার। তাই আগামী বাজেটে শুল্ক-কর ছাড় দিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আগের ধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ করে কমতে পারে। বছরে তিন কোটি টাকার বেশি লেনদেনের প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসাননির্বিশেষে ন্যূনতম কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। আবার উৎপাদনমুখী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়াতে আমদানি পর্যায়ে আগাম ভ্যাট ১ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হতে পারে। এসব কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে যেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর করের বোঝা কমে এবং করোনার বিপর্যয়ে টিকে থাকার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

সার্বিকভাবে আগামী বাজেটে নতুন গরিবদের জন্য সহায়তা কর্মসূচির পরিবর্তে তাদের যেন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে, সে জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা রাখার উদ্যোগই বেশি থাকছে।