কৃষক থেকে সফল উদ্যোক্তা খুলনার মঞ্জুর
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ফল খুব একটা ভালো হয়নি। তবু উচ্চশিক্ষার জন্য স্নাতকে ভর্তি হন। কিন্তু লেখাপড়ার এ ফল নিয়ে খুব বেশি দূর যে এগোনো যাবে না, নিজের মধ্যেই এমন ধারণা তৈরি হয় খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের তরুণ শেখ মঞ্জুর রহমানের। তাই লেখাপড়ার আনুষ্ঠানিক পাট চুকিয়ে মনোনিবেশ করেন কৃষিকাজে। সেখানে পেলেন সফলতা। প্রথমে শুরু করেন মাছ ও ধান চাষ। এরপর শুরু করেন বীজ উৎপাদন ও বিপণন।
এখন মঞ্জুর বোরো ধান, আমন, সরিষা, তিল, মাষকলাইসহ নানা ধরনের সবজির বীজ উৎপাদন ও প্যাকেটজাত করে তা বাজারজাত করছেন। তাঁর উৎপাদিত এ বীজ ডুমুরিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে পাশের জেলা ও উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রতিবছর শুধু ১২ মেট্রিক টন বোরো বীজই উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন মঞ্জুর। তাতে সব মিলিয়ে খরচ বাদে তাঁর বার্ষিক মুনাফা ৬ লাখ টাকার ওপরে।
সম্প্রতি শেখ মঞ্জুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি জানান, ২০০৬ সালে এইচএসসি পাসের পর স্নাতকে ভর্তি হন। তখনই মনস্থির করেন কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে নেওয়ার। প্রথমে বাবার কিছু জমি নিয়ে শুরু করেন মাছের ঘের। এরপর তরুণ মঞ্জুরের মাথায় আসে মাছের ঘেরে ধান চাষের। যেই চিন্তা, সেই কাজ। শুরু করেন ধান চাষ। প্রথমবারই ভালো ধান হয়। তবে বাজারে ধানের দাম কম থাকায় সেবার লোকসান হয় তাঁর। তা সত্ত্বেও পরেরবার আবারও ধান চাষের উদ্যোগ নেন। এবার সংকট দেখা দেয় ভালো বীজের। বাজারে ভালো বীজের সংকট দেখে মঞ্জুরের মাথায় প্রশ্ন জাগে, সরকার ও বিভিন্ন কোম্পানি যে বীজ বিক্রি করে, তা কোথা থেকে আসে।
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে শরণাপন্ন হন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে পড়ুয়া তাঁর বড় ভাইয়ের কাছে। জানতে পারেন কীভাবে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা যায়, কীভাবে বীজ উৎপাদনের লাইসেন্স পাওয়া যায়, সেসব বিষয়। এরপর নিজের অভিজ্ঞতা ও কৃষি বিভাগের পরামর্শে শুরু করেন বীজ উৎপাদন।
তরুণ মঞ্জুর বলেন, ‘বীজ উৎপাদনের পর তা আমার নিজের দোকানে রেখে বেচতে শুরু করি। কৃষকও তাঁর বীজ ব্যবহার করে ভালো ফলন পেতে শুরু করেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ডের বীজ উইং থেকে উৎপাদনের নিবন্ধন নিই।’
>খুলনার ডুমুরিয়ার টিপনা গ্রামের মঞ্জুরের ‘শেখ এগ্রো’ নামের প্যাকেটজাত বীজের সুনাম এখন ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকায়ও।
বর্তমানে শেখ এগ্রো নামে প্যাকেটজাত বীজ বিক্রি করেন মঞ্জুর। পাশাপাশি নিজেই গড়ে তুলেছেন বীজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র। তাই এখন আর তাঁর উৎপাদিত বীজ অন্য কোনো প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে নিতে হচ্ছে না। চলতি মৌসুমে ব্রি ২৮, ৫৮, ৬৭ জাতের ১০ টন ভিত্তি বীজ এবং আমন ব্রি ৮৭, ৪৯, ৭৫ জাতের ২ টন মানঘোষিত বীজ তিনি বিপণন করেছেন। এ ছাড়া তাঁর কাছে এখন ৫০০ কেজি সরিষা, ২০০ কেজি তিলবীজ বিক্রির জন্য প্রস্তুত আছে। আর মাঠে বীজের জন্য লাগানো মাষকলাইয়ে ফুল এসেছে।
মঞ্জুরের গ্রামের আবদুর রশিদ গাজী বলেন, ‘তার কাছ থেকে বীজ নিয়ে কখনো ঠকিনি। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা তাকে সব সময় কাছে পাই। বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সে আমাদের সহায়তা করে। কিছু বাকিতেও বীজ-কীটনাশক কেনা যায়।’
ডুমুরিয়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, বর্তমানে মঞ্জুর একজন সফল কৃষকের পাশাপাশি সফল ব্যবসায়ীও। ব্যক্তি উদ্যোগে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের বীজ উৎপাদনের তেমন নজির এখানে নেই। অথচ মঞ্জুর বীজ উৎপাদনের পাশাপাশি নিজের উদ্যোগে বীজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রও তৈরি করেছেন। কৃষক থেকে ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার এ নজির সত্যিই অনন্য।