কুরিয়ারের বাজার বাড়ছে, তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে

করোনা মহামারির কারণে প্রায় সব খাতের ব্যবসাই খারাপ হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম কুরিয়ার সেবা খাত। সরকারি নির্দেশে রাস্তায় যখন গাড়ি চলাচল বন্ধ, অফিস-আদালত, দোকানপাটও বন্ধ, এমনকি বিনা প্রয়োজনে মানুষের হাঁটাচলা করতেও মানা, এমন দমবন্ধ সময়ে আগের তুলনায় বেশি সচল থেকেছে কুরিয়ার সেবা।

করোনার কারণে ঘরবন্দী মানুষের দুয়ারে নিত্যপণ্য, খাবার, ওষুধ, জামা ইত্যাদি পণ্য পৌঁছে দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে কুরিয়ার সেবাদাতা কোম্পানিগুলো। কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতি কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি) নিজেই বলছে, করোনার কারণে এই সময়ে যেহেতু অনলাইনে কেনাকাটা বেড়েছে, তাতেই ব্যবসা বেড়েছে তাদের।

এই সময়ে নতুন নতুন অনলাইন কুরিয়ার সেবাদাতা কোম্পানিও গড়ে উঠেছে দেশে। এটাও ব্যবসা বৃদ্ধির আরেক কারণ। তবে প্রকৃতপক্ষে দেশে কতটি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি রয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। সিএসএবির অনুমান, দেশে ৫০০-এর মতো কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি থাকতে পারে। তার মধ্যে সিএসএবির সদস্য ১৩৯।

কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা করতে হলে মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্স বা নিবন্ধন নিতে হয়। পাশাপাশি সিএসএবির সদস্যপদ নিতে হয়। সিএসএবির সদস্য হলেও অনেকে আবার লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্স নেয়নি, নিয়েছে মাত্র ৭২টি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে কুরিয়ার সেবা খাতটি বড় হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় যেনতেনভাবে।

দেশের কার্যকর অভ্যন্তরীণ কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসেস, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস, ওয়ার্ল্ড রানার এক্সপ্রেস, এক্সপ্রেস ওয়ান, পদ্মা কুরিয়ার, মধুমতি এক্সপ্রেস, ড্রিমল্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসেস, প্রভাতী কুরিয়ার, রেইনবো কুরিয়ার, জননী কুরিয়ার ইত্যাদি। অভ্যন্তরীণের পাশাপাশি অনবোর্ড কুরিয়ার এবং আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে দেশে।

সাত হাজার কোটি টাকার বাজার

প্রতিষ্ঠিত অভ্যন্তরীণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মতিঝিল কার্যালয়ের সামনে গত বুধবার সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা যায় নিচে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। এই গাড়িতে করে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পণ্য নিয়ে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন কর্মীরা। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তাদের নাম দিয়েছে ‘ডেলিভারি হিরো’। ভেতরে গিয়ে দেখা যায় কেউ পণ্য প্যাকেট করছেন, কেউ তা নিচে নামাচ্ছেন। কেউবা কম্পিউটারে পোস্টিং দিচ্ছেন এবং ট্র্যাকিং পদ্ধতি তৈরি করছেন।

সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সিএসএবির সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ খাতটির বাজার প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার। আর প্রায় দুই লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে জড়িত। এ খাত যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তা কোভিড আসার পর নিশ্চয়ই অনেকে বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু যে খাতটি সেবা খাত হিসেবে এখনো স্বীকৃত নয়।’

সিএসএবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধস এবং এর পরের ১০ বছরে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অনলাইন পদ্ধতি বেশি হারে চালু হওয়ার পর থেকে ৪০ থেকে ৫০টি কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানী, বিভাগীয় এবং জেলা শহর পর্যন্ত সেবা দিত। এখন দিচ্ছে থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও। করোনা আসার পর থেকে প্রায় দেড় বছরে পণ্য পৌঁছানোর আদেশ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

কোভিডের দেড় বছরে কোনো কুরিয়ার সেবা নিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে ঢাকার নিউ ইস্কাটনের বাসিন্দা ফাতেমা বেগম জানান, ‘যেদিনই কিছু রাঁধতে ইচ্ছে করে না, সেদিন অনলাইনে খাবার অর্ডার করি। সাইকেলে করে বাসার সামনে এসে দিয়ে যায় কুরিয়ার কোম্পানির তরুণ কর্মীরা। আমার কাছে এটাই একটা সুখের বিষয়।’

আছে কিছু সমস্যাও

গুণগত মানসম্পন্ন না হলে পণ্যের ভালো একটা অংশ গ্রাহকদের কাছ থেকে ফেরতও আসে। ক্রেতা অনলাইনে যে পণ্য দেখে ক্রয় আদেশ দিয়েছেন, তার সঙ্গে অমিল দেখলেই তা তিনি না নিয়ে ফেরত পাঠান। এগুলো তখন আমাদের গুদামে রাখতে হয়। এ জন্য গুদামের একটা জায়গাও দখল হয়। এটা একটা বড় সমস্যা। একশ্রেণির ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা হচ্ছে।’

সিএসএবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধস এবং এর পরের ১০ বছরে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অনলাইন পদ্ধতি বেশি হারে চালু হওয়ার পর থেকে ৪০ থেকে ৫০টি কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো ছিল ডকুমেন্টভিত্তিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান।

আবার কোনো একটি খাতের জন্য সাধারণত একটি করে সমিতি থাকলেও এ খাতে রয়েছে পাঁচটি সমিতি। সিএসএবি ছাড়া বাকিগুলো হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএইএবি), অন বোর্ড কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পার্সেল সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ প্রাইভেট কেরিয়ার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।

লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কাছে সম্প্রতি এক আবেদনে সিএসএবি জানিয়েছে, অনবোর্ড ও আন্তর্জাতিকের তুলনায় অভ্যন্তরীণ কুরিয়ারের লাইসেন্স ফি ও জামানত অস্বাভাবিক বেশি। অভ্যন্তরীণ কুরিয়ারের একটি চিঠি বা ডকুমেন্ট বুক করলে যেখানে ১০ থেকে ১৫ টাকা নেওয়া হয়, সেখানে অনবোর্ড কুরিয়ার নেয় এক হাজার টাকা আর আন্তর্জাতিক কুরিয়ার নেয় দুই হাজার টাকা। সে হিসাবে অভ্যন্তরীণ কুরিয়ারের জামানত ও লাইসেন্স মাশুল কম হওয়ার কথা। কিন্তু সরকার করছে উল্টো।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত ২৬টি

শুধু ভারত থেকে পণ্য বা পণ্যের নমুনা নিয়ে আসে এমন কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৬টি। এর মধ্যে কার্যকর ১৫টি। বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে জুয়েলারি, পোশাক, হার্ডওয়্যার, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি পণ্য কুরিয়ারে আসে ভারত থেকে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েই গড়ে উঠেছে অনবোর্ড কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।

অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মাহমুদ আলম জানান, অভ্যন্তরীণ কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড সময়ে খুব ভালো সেবা দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ সেবায় আন্তর্জাতিক কুরিয়ার

আইএইএবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার কোম্পানি রয়েছে ৭৮টি। এর মধ্যে কার্যকর ৪০টি। শীর্ষ ৫ কোম্পানি হচ্ছে ডিএইচএল, ইউপিএস, ফেডেক্স, অ্যারামেক্স এবং স্কাই নেট। এ ছাড়া রয়েছে ড্রাগন এক্সপ্রেস, ইউনি এক্সপ্রেস, এসটিও বিডি ইন্টারন্যাশনাল, ফ্লাইবার্ড এক্সপ্রেস, ওসিএস, ফাস্ট এক্সপ্রেস, মাস্টার এয়ার ইত্যাদি। নতুন করে এসেছে রেডেক্স।

আইএইএবির সাধারণ সম্পাদক এবং স্কাই নেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেখানে অফিস আছে, সেখানে আমরা পণ্য বা ডকুমেন্ট সরবরাহ নিজেরাই করেছি। যেখানে নেই, সেখানে অভ্যন্তরীণ কুরিয়ারের সহায়তা নিয়েছি। তবে দায়িত্বটা আমরা ঠিকই পালন করে যাচ্ছি।’

রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘কোভিডে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক কুরিয়ারগুলোর ব্যবসা কমেছে। যদিও নিজস্ব সক্ষমতা বেশি থাকায় ফেডেক্স, ডিএইচএলের মতো কোম্পানির ব্যবসা বেড়েছে।’

গড়ে উঠছে অনলাইন কুরিয়ার

গ্রাহককে দ্রুততম সময়ে সেবা দিতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অনলাইনভিত্তিক কুরিয়ার সার্ভিস। তারা উদ্যোক্তা বা মার্চেন্ট ও গ্রাহকদের মধ্যে যোগসূত্রের কাজটি করছেন। প্রথম দিকে এ সেবা ছিল ব্যক্তিপর্যায়ে। এখন অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও এ খাতে বিনিয়োগ করেছে।

জানা গেছে, ই-কুরিয়ার নামক একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র চারটি বাইসাইকেল নিয়ে ২০১৪ সালে প্রথম অনলাইনভিত্তিক কুরিয়ার সার্ভিসের যাত্রা শুরু করে। এখন তাদের মোটরবাইক রয়েছে শতাধিক। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতেও রয়েছে ই-কুরিয়ারের সেবা।

একই রকম অনলাইনভিত্তিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিদ্যুৎ লিমিটেড। এটি ২০১৬ সালে শুরু হওয়া কনকর্ড গার্মেন্টস গ্রুপের উদ্যোগ। আরেকটি অনলাইনভিত্তিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ফারাজী গ্রুপের সি এক্সপ্রেস লিমিটেড। এটি গড়ে ওঠে ২০১৭ সালে। এ ছাড়া বাসায় তৈরি খাবার, শাড়ি, গয়না, পোশাক বিক্রেতাদের পণ্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে কিছু অনলাইন কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী যা বললেন

পুরো কুরিয়ার খাতের নানা দিক নিয়ে গত শনিবার ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘কোভিড-১৯ আসার পর ঘরে বসে আমরা কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর সেবা পেয়েছি। নিঃসন্দেহে তারা ভালো কাজ করেছে। তারা না চাইতেও জরুরি সেবার মধ্যে কুরিয়ার সেবাকে রেখেছে সরকার।’

কুরিয়ার সেবা এখনো সেবা খাত হিসেবে স্বীকৃত নয় কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘তারা কখনোই তা চায়নি। চাইলে তারা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করুক।’

এস এ পরিবহনের মতো অনেকেই লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছে, অথচ লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ কিছুই বলছে না। কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। কিছুটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে উঠছে এ খাত। শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ চলছে।’