তিনটি জিনিস বলতে চাই। এক. অবশেষে এবারের বাজেট বক্তৃতায় অর্থনীতিতে বিদ্যমান সমস্যার একধরনের স্বীকৃতি আছে; ২. এসব সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সমন্বিত মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি অনুপস্থিত। ৩. বাজেটের সঙ্গে আয়-ব্যয়ের কাঠামোতে সংগতিপূর্ণ পরিবর্তন নেই, আয় কাঠামোতে যা-ও আছে, ব্যয় কাঠামোতে তা–ও নেই।
দেখা যাচ্ছে, আগে যেসব খাত বা কর্মকাণ্ড করের আওতার বাইরে ছিল বা অব্যাহতিপ্রাপ্ত ছিল, এবার সেখানে করারোপ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে করহার সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। পদ্ধতিগত সংস্কারের চেষ্টা আছে সরকারের। উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে করের সাযুজ্য আনার চেষ্টা আছে।
সমন্বয়ের প্রসঙ্গে বলতে হয়, অভ্যন্তরীণ শিল্পের কর–সুবিধা কিছুটা অনুকূল। কিন্তু ব্যয়কাঠামোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখছি না। শিক্ষা খাতে এখনো জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ—২ শতাংশের নিচে; স্বাস্থ্য খাতে শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ—জিডিপির ১ শতাংশের নিচে এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আমাদের প্রস্তাব ছিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বরাদ্দের হার বৃদ্ধি করার, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ভর্তুকি বেড়েছে; কিন্তু এর সিংহভাগ চলে যাবে পিডিবিতে; তার মধ্যে আছে ব্যক্তি খাতের অলস কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেওয়া অন্যায্য সুবিধা।
তবে সরকার সংযতভাবে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এই প্রথম সরকারি ব্যয় জিডিপির অনুপাতে হ্রাস করা হয়েছে। অন্যদিকে জিডিপির প্রাক্কলন অপরিবর্তিত রয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। ফলে জিডিপির হিসাব যা বাস্তব অর্থনৈতিক সূচক নয়; বরং তা যেন রাজনৈতিক সূচকে পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির হারকে যে সুতাকাটা ঘুড়ির সঙ্গে তুলনা করেছিলাম, তার যৌক্তিকতা আরও একবার প্রমাণিত হলো।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, কিন্তু ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে তা কীভাবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে যাবে, তার পথরেখা নেই। বিলাসদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করে সীমিত ফল পাওয়া যাবে। আর ব্যয়প্রবাহ সংকোচনের সুযোগও কম।
পরিশেষে বলব, বিভিন্ন ধরনের করহারের মধ্যে সাযুজ্য আনার চেষ্টা করা হলেও তা শেষমেশ মনে হয় কর–ন্যায্যতার পরিপন্থী বাজেট হয়ে গেল। করপোরেট করহার কমানো হলো, কিন্তু ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা হলো না, এখানেই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পায়।
আবার পাচার হওয়া সম্পদ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হলো। যদিও বলা হয়েছে, বিদেশি অর্জিত সম্পদ; আদতে তা পাচার হওয়া সম্পদ। নির্বাচনমুখী বছরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রশ্নের জন্ম দেবে, বিশেষ করে বিদেশে যখন প্রবাসীদের অবৈধ সম্পদের খোঁজ হচ্ছে। এ সময় এমন পদক্ষেপের তাৎপর্য আরও বেশি।
আবার এতে আদৌ অর্থ দেশে আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেউ বিশ্বাস করবেন কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়। প্রস্তাবিত এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে এই সরকারের ভেতরে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী কারা—গরিব মানুষ যেখানে সামাজিক সুরক্ষা ভাতায় জিডিপির ১ শতাংশের বেশি পাবেন না, সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের সুবিধা পাবেন।
বলা বাহুল্য, এটা শাসক দলের জন্য অর্থনৈতিক সংকটকালে অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে আসবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিশেষ ফেলো, সিপিডি