'সবাই দৌড়ের ওপর আছে'
জাহিদের (ছদ্মনাম) বয়স ২৯ বছর। শৈশব থেকেই মা-বাবার কঠোর অনুশাসনের মধ্যে মানুষ। নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে ছিল তাঁর জীবন। এটা করা যাবে না, সেটা বলা যাবে না! একপর্যায়ে মা-বাবাকেই তাঁর ভয় লাগতে শুরু করে। কারণ, নিজের খারাপ লাগাটা মা-বাবাকে জানানোর মতো সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি জাহিদের। সেই হতাশা থেকেই মাদকের সঙ্গে নৈকট্য তাঁর।
মাদক থেকে জাহিদ পুরোপুরি মুক্তি পাননি। এখনো চলছে পুনর্বাসন। তিনি বলেন, মা-বাবার সঙ্গে একটি প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁরা আদেশ করতেন এবং তিনি পালন করতেন। নিজের ইচ্ছের কথাও মুখ ফুটে বলতে পারতেন না। গড়ে ওঠেনি কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ সুস্থ সম্পর্ক। আর সেই হতাশাই একসময় তাঁকে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়।
প্রথম আলোর উদ্যোগে পরিচালিত তারুণ্য জরিপের দ্বিতীয় কিস্তি আজ সোমবার প্রকাশিত হয়েছে। এই জরিপে দেখা গেছে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তরুণেরা, দূরত্ব বাড়ছে মা-বাবার সঙ্গে। জরিপে অংশ নিয়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণই বলেছে যে পরিবার ও মা-বাবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারাটাই তাদের জন্য সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়েও তরুণদের দুশ্চিন্তা রয়েছে। জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে পরিবার থেকেও খুব বেশি সহায়তা পাচ্ছে না তারা।
শামীমা আফরোজ দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। তবে যে বিষয়ে পড়েছিলেন, সেটি আসলে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল চারুকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার। কিন্তু পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হয় অন্য বিষয় নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁদের ধারণা, চারুকলায় পড়লে ভবিষ্যৎ নেই! শামীমা বলেন, ‘ছয় বছর পড়ার পরও এ বিষয়ের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই আমার। ভর্তি পরীক্ষার আগে আমি মা-বাবাকে বোঝাতেই পারিনি। তাঁরা শুধু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন। আমার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ভাবেননি। এখন ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে বিভ্রান্ত আমি। কী হতে চাই, বুঝতে পারি না।’
প্রথম আলোর এই জরিপে অংশ নেওয়া ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ কমবেশি একমত যে মানুষ ক্রমাগতভাবে আত্মকেন্দ্রিক বা স্বার্থপর হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ একমত ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কিছুটা একমত ২০ দশমিক ৮ শতাংশ।
একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেন তারিফ-উজ-জামান। চাকরির কারণ প্রায় সময়ই পরিবার ছেড়ে অনেক দিন দেশের বাইরে থাকতে হয় তাঁকে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বায়ন, মিডিয়া ও করপোরেট দুনিয়ার কারণে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দৌড় ও ভয় আমাদের সবার মধ্যে ঢুকে গেছে। সবাই দৌড়ের ওপর আছে। সবখানে শুধু পিছিয়ে পড়ার ভয়। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোতেও এই ভয় ঢুকে গেছে। অভিভাবক, সন্তান, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক—সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আমাদের পৃথিবী এখন ফেসবুক। নিজেকে প্রকাশের উপায় সেলফি।’
জরিপে অংশ নেওয়া ৬০ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ বলেছে, জীবনের বিভিন্ন বিষয় বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা মায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মেয়েদের মধ্যে এই হার ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ছেলেদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ। আর সমস্যায় পড়লে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতা তামজিদা তুবা (২৮)। তাঁর মতে, বন্ধু ও প্রেমিকের সঙ্গেই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয় বেশি। ছোট ভাইয়ের সঙ্গেও কিছু কিছু কথা হয়। কিন্তু মা-বাবাকে এর মধ্যে জড়ানো হয় না। কারণ, তাঁরা দুশ্চিন্তা করেন বেশি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা দীপিকা সরকার বলেন, ‘নিজের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে মাকেই পেয়েছি। বন্ধু, প্রেমিক বা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলে কখনো ভালো ফল পাইনি। সব রাগ, দুঃখ কিংবা দোষ স্বীকার করার পর মানসিক শান্তি ও সমর্থন পেয়েছি শুধু মায়ের কাছ থেকেই।’
এই জরিপের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এস আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, তরুণদের আগে যে একটা ভাবাদর্শগত অবস্থান ছিল, সেটা এখন আর নেই। এখন তারা অনেক বেশি বাস্তববাদী। এটা পুরো সমাজেরই পরিবর্তনের একটি প্রতিচ্ছবি। এর চেয়ে এখন তরুণদের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আকর্ষণ অনেক বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক ছাত্র লিটন বড়ুয়া এখন কাউন্সেলিং করেন। এই পেশায় অন্যের সমস্যা নিয়েই কাজ করতে হয় তাঁকে। লিটনের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্যাটেলাইট চ্যানেল ও ইন্টারনেট, তরুণদের চাওয়া-পাওয়া ও জীবনবোধকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। কিন্তু পরিবর্তনের উপাদানগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য নেই।
তিনি বলেন, ‘একটা শিশু ছোটবেলায় শিখছে সততা সর্বোত্তম পন্থা। কিন্তু বড় হয়ে দেখছে সততার দাম নেই। এটি মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। আর এটুকুই একটি পরিবারকে এলোমেলো করার জন্য যথেষ্ট।’