প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন নানার বাবা, নানা ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা আর নাতি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা। রক্তের ধারায় যোদ্ধা—এমন বংশগতির এক মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া চা-বাগানের মালিক জেমস লিও ফারগুসন। মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের ৫ নম্বর সাবসেক্টরের অধীন স্কটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি যোদ্ধা তিনি।
সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কানাইঘাটের লোভাছড়া চা-বাগানে বসবাস হলেও জেমস লিও ফরগুসনের পৈতৃক নিবাস স্কটল্যান্ডে। নানকা তাঁর ডাকনাম। লোভাছড়া চা-বাগানসহ আশপাশের এলাকার মানুষজন তাঁকে ডাকনামেই বেশি চেনেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছিলেন নানকা। কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত টানা ১৭ বছর। এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় ‘নৌকা প্রতীকের টানে’ প্রায় দুই দশক বিরতি দিয়ে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবারও ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন। সম্প্রতি প্রথম আলোর সিলেট কার্যালয়ে এলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
লিও ফারগুসন জানালেন, তাঁরা স্কটিশ। স্কটল্যান্ডে মূল বাড়ি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৩-১৮ সাল) তাঁর নানা জেমস আর্থার ফারগুসনের বাবা ডোনাল্ড ফারগুসন সরাসরি অংশ নেন। সেই সুবাদে ছেলে জেমস আর্থার ফারগুসন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরে আর্থার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫ সাল) অংশ নেন। ব্রিটিশ সেনাসদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি।
কানাইঘাটের লোভাছড়ায় লিও ফারগুসনের জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আর্থার ফারগুসন সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ‘ইন্ডিয়া ইসাবেলা টি এস্টেট’-এ চাকরির সুবাদে চা-বাগানে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। পরে লিও ফারগুসনের মা জুন ফারগুসন লোভাছড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপক হন। তৎকালীন ভারত ও পাকিস্তানে তিনিই ছিলেন কোনো চা-বাগানের প্রথম নারী ব্যবস্থাপক। বাবা জে ফারগুসন ছিলেন ব্যবসায়ী। তিনি মাঝেমধ্যেই এখানে আসতেন। পরে তাঁরা লোভাছড়া চা-বাগানের মালিক হন।
ক্যাডেটের শিক্ষার্থী ছিলেন জেমস লিও ফারগুসন। কুমিল্লার ময়নামতিতে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ক্যাডেট কোর্স সমাপন করছিলেন। এপ্রিলের শেষ দিকে একদিন রাতে ময়নামতি থেকে পালিয়ে লোভাছড়ায় আসেন। মায়ের সম্মতি নিয়ে সেখান থেকে সরাসরি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
পূর্বপুরুষের বিশ্বযুদ্ধের গরিমা কি মুক্তিযুদ্ধে টেনেছে? এমন প্রশ্নে জেমস লিও ফারগুসন মাথা নাড়েন ঠিকই। কিন্তু জবাবে বললেন, ‘জন্মেছি এই মাটিতে। যুদ্ধ লেগে গেল বলে মাটির টানে যুদ্ধ করেছি। মা আমাকে প্রেরণা দিয়েছে। ৫ নম্বর সাবসেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাস থেকে যুদ্ধে নামি। স্কটিশ হিসেবে সহযোদ্ধাদের প্রিয় ছিলাম। সহযোদ্ধা সবাই সাহস জুগিয়েছেন। আমার পূর্বপুরুষদের কথা শুনেও তাঁরা উজ্জীবিত হয়েছেন।’
লিও ফারগুসন জানান, প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব কাহিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে শোনা। লোভাছড়া চা-বাগানে তাঁর যে বাংলোঘর রয়েছে, সেখানে নানা আর নানার বাবার যুদ্ধকালীন কিছু ছবির বিরল সংগ্রহ রয়েছে। একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর নানা জেমস আর্থার ফারগুসনেরও কিছু ছবি রয়েছে। সঙ্গে জেমস লিও ফারগুসনের মুক্তিযোদ্ধার সনদ। এসবই যেন তিন প্রজন্মের তিনটি যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করছে।
জেমস লিও ফারগুসন ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালে ১৯৮২ সালে বিয়ে করেন স্কটিশ নাগরিক কুইনলাকে। স্ত্রী, দুই ছেলে রয়েছে তাঁর। লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস স্ত্রী-সন্তানদের। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তবে জনপ্রতিনিধি হওয়ায় লোভাছড়ায় স্থায়ী হয়েছেন তিনি।
ফারগুসন চা-বাগানে নিভৃতে বিজয় দিবস উদ্যাপন করেন। এ বিষয়টি জানেন সিলেটের অনেক মুক্তিযোদ্ধাও। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা কমান্ডের কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নানকা (জেমস লিও ফারগুসন) আসলে নিভৃতচারী স্বভাবের। আমার জানামতে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিনিই একমাত্র স্কটিশ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এ নিয়ে তিনি কোনো ধরনের প্রচারে আসতে চান না। গত বছর বিজয় দিবসে আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর বাগানে গিয়েছিলাম সংবর্ধনা দিতে। তিনি সংবর্ধনা না নিয়ে পুরো দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আডডা দিয়ে কাটালেন। ওই দিন যেন বিজয়ের আবেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনমেলা বসেছিল লোভাছড়া চা-বাগানে।’