'নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম ঘুচায়ে...'
হাত ধোয়ার কথা আজ বারবার বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হিসেবে। কিন্তু ১৮৪০ সালে হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী ড. ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ প্রথম অনুধাবন করেছিলেন যে হাত ধোয়ার সঙ্গে রোগ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে যাওয়ার আছে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। বিশ্বের কোটি মানুষকে অনিবার্য মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ফল হিসেবে সেই ডাক্তারকে পাগলা গারদে যেতে হয়েছিল চক্রান্তের শিকার হয়ে। পরে সেখানকার নিরাপত্তারর্ক্ষীরা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেন।
এ বছরের ১৫ জুন। বাংলাদেশে ডাক্তার রকিবকেও পৈশাচিক হামলার শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে রোগীর স্বজনদের হাতে। তাঁর অপরাধ ছিল এই করোনা মহামারিতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে গ্রাম্য ধাইয়ের অপচিকিৎসার শিকার মরণাপন্ন এক রোগীকে তিনি বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরে রোগীটির জটিলতা দেখা দিলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। পথিমধ্যে রোগীটি মারা যায়। ক্রুদ্ধ রোগীর স্বজনেরা এসে ডাক্তার রকিবকে আঘাত করেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে পরদিন তাঁর মৃত্যু হয়। পরোপকারী চিকিৎসক ডাক্তার রকিব ‘গরিবের ডাক্তার’ নামে নিজ এলাকা খুলনা ও বাগেরহাটে পরিচিত ছিলেন ত্যাগ ও সেবার জন্য।
১৮৪০ থেকে ২০২০। প্রেক্ষাপট যা–ই হোক, সেই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো কিন্তু আজও ঘটেই যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই স্বাস্থ্যকর্মী শুধু নয়, সব ধরনের পেশাজীবী এমন সহিংসতার শিকার হন যুগে যুগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর ৮% থেকে ৩৮% চিকিৎসাসেবাকর্মী শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন সারা বিশ্বে।
জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে, উন্নতিতে পৃথিবী, সভ্যতা ও সমাজ এগিয়েছে অনেক দূর। কিন্তু কিছু মানুষের অন্তর্গত ক্রোধ, গোঁড়ামি অন্ধত্ব, পৈশাচিকতা তাকে করে তোলে অমানবিক। তাই হয়তো প্রাণ দিতে হয় রকিবের মতো মানবিক ডাক্তারদের। প্রাণ দিতে হয় ডা. রওশন আরাকে, যিনি ২০০৯ সালে কর্মস্থলে বখাটের ছুরিকাঘাতে খুন হন। এমন অনেককেই। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তো আছেই। বাংলাদেশে তাই আজ ‘চিকিৎসক সুরক্ষা আইন’ এখন সময়ের দাবি।
সারা বিশ্বে চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য নানান রকম আইন প্রণয়ন হয়েছে। ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রশাসনিক ও আইনগত নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভারতে ২০০৮ সাল থেকে মোট ১৮টি প্রদেশে চিকিৎসক এবং চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা–সম্পর্কিত আইন পাস করা হয়।
‘ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনা হলেই চিকিৎসককে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার নয়’—এ মর্মে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একাধিক নির্দেশনা দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ১৯৯৯ সালে স্বাস্থ্য খাতে হামলা রোধে ‘জিরো টলারেন্স জোন ক্যাম্পেইন’ চালু করেছে।
বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে ও পরিবারকে মৃত্যুঝুঁকিতে রেখে দায়িত্ব পালনে তাঁরা অবিচল। তাই জনগণ ও রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব চিকিৎসকদের কাজের ও ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন করা। তাঁদের সার্বিক সুরক্ষা, অধিকার নিশ্চিত করা ও উৎসাহিত করা।
এ বছরই মানে ২০২০–এ করোনা আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলাদেশের ৩০ জনের বেশি প্রথিতযশা চিকিৎসক। তাঁদের অনেকের মৃত্যুর জন্যও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রকে দায়ী করা যায়। আমাদের দেশের অসচেতন জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় সংক্রমণের সংখ্যা কমিউনিটি পর্যায়ে ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে এবং আশঙ্কাজনকভাবে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে পিপিই, মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রী ভালো না হওয়ায় সম্মুখযোদ্ধারা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন। অপ্রতুল অদক্ষ জনবল, বিকল যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতি এই করোনা মহামারিতে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত বা মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি তাঁদের প্রতি জনগণের একধরনের অনাস্থা তৈরি হয়।
এসব নানাবিধ কারণে মেধাবী প্রজন্ম ক্রমেই এই মহান পেশার প্রতি সম্মান বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকবে। অথচ কিছুদিন আগেও পরিবার তথা প্রায় সবার স্বপ্ন ছিল জীবনে এই পেশায় সফল হওয়ার।
এখন তাই সার্বিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন চিকিৎসকসমাজ ও জনগণের পারস্পরিক সম্মানবোধ। গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, গানে চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশাকে যেমন সেবা ও সম্মানজনক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, আবার তেমনি অনেক নেতিবাচক দিক অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়, যা একেবারেই কাম্য নয়।
‘সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার, ক্ষিধে পেলে পানি খায় চিবিয়ে’ এখানে ডাক্তারকে হাস্যকর কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে শিশুর মনোজগতে ছবি আঁকা হয়েছে। ছোটবেলায় পড়া ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল’ পড়ে মনেই হবে ডাক্তার মানে দায়িত্বহীন ব্যক্তি। উত্তম–সুচিত্রার বাংলা সিনেমায় দেখানো হয়েছে ডাক্তার মানেই বিনে পয়সার সেবক, যা একেবারে বাস্তবতাবিবর্জিত। হালে নচিকেতার গানে ডাক্তারকে অর্থলোভীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
চিকিৎসাব্যবস্থা ও চিকিৎসকসমাজকে নিয়ে এসব নেতিবাচক চিত্র যেকোনো জাতির জন্য অশনিসংকেত বয়ে নিয়ে আসবে। আর ডাক্তারদের ওপর এমন অন্যায় হামলা বা বঞ্চনার ঘটনা ঘটতে থাকলে মেধাবীরা আর কেউ এ পেশায় আসতে চাইবে না। আর জনগণ হবে অবৈজ্ঞানিক অপচিকিৎসার শিকার।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে সমাজের সবচেয়ে মেধাবী জনগোষ্ঠীর একটি অংশ চিকিৎসা পেশায় আসেন। অনেক শ্রম, জীবনের মূল্যবান অনেক সময় ব্যয় করে, অনেক আত্মত্যাগের পর একজন ছেলে বা মেয়ে ডাক্তার হতে পারে। তারপরের পথ আরও কষ্টকর। বাংলা সিনেমায় যে দেখানো হয় ডাক্তার সাহেব নায়িকার হাত দেখে বললেন ‘আপনি মা হতে চলেছেন।’ ডাক্তারি বিদ্যা এত সহজ নয়। প্রতিনিয়ত বিশ্বের জ্ঞান–বিজ্ঞানের সঙ্গে, গবেষণার সঙ্গে তাঁকে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, জ্ঞান অর্জন করতে হয়। মেধা, যোগ্যতা না থাকলে শুধু স্বপ্ন বা ইচ্ছা দিয়ে কেউ সফল চিকিৎসক হতে পারে না।
পৃথিবীর সব দেশে চিকিৎসকদের অবদান পরিবারে, সমাজে, দেশে অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, স্বৈরাচারী আন্দোলন, করোনা মহামারি—এমন বহু ইতিহাসের সঙ্গে আছে এ দেশের চিকিৎসকসমাজের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা, আছে মহান আত্মত্যাগ। একজন ডাক্তার সম্পূর্ণ শ্রম, মেধা, ভালোবাসা, যত্ন দিয়ে রোগীকে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। বেশির ভাগ রোগীও চিকিৎসককে তাঁদের শ্রদ্ধায়, নির্ভরতায় দেবতার আসনে বসান।
একজন মানুষের জন্ম থেকে সর্বদা সুস্থভাবে বেঁচে থাকা, মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর পরও প্রয়োজন একজন চিকিৎসককে। এ ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।
তাই চলুন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে চিকিৎসাসেবকদের, যোদ্ধাদের আমরা সম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করি। আমাদের জীবনে, সমাজে তাঁদের গুরুত্ব ও প্রয়োজন সততার সঙ্গে অনুধাবন করি। তাঁদের উজ্জ্বল কীর্তি তুলে ধরি আমাদের প্রজন্মের কাছে। শিশুদের মনে স্বপ্ন বুনে দিই বড় হয়ে তারা যেন আদর্শ মানুষ হয়। একজন দক্ষ চিকিৎসক হয়ে আমাদের চিকিৎসার ভার নিতে পারে। কেননা এই ১৭ কোটি মানুষের দেশে বহুসংখ্যক চিকিৎসকের বড় প্রয়োজন।
আমাদের আছে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন দেশ স্বাধীন করার জন্য। আর তেমনি একজন ডাক্তার যুদ্ধ করেন মানুষের জীবন বাঁচাতে। তাই মহতী এই জনগোষ্ঠীকে অনুধাবন করতে হবে, উপস্থাপন করতে হবে দেশের অত্যাবশ্যক সম্পদ হিসেবে। মেধাবী, সৎ, পরিশ্রমী ও মানবিক জনসম্পদ হিসেবে।
সন্তানের কাছে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সফলতার গল্প তুলে ধরুন। তাদের জানান বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এখন দেশেই হচ্ছে। তাদের জানা দরকার মেধাবী ডাক্তার দ্বারা গুলিবিদ্ধ মা ও তার পেটের বাচ্চাকে বাঁচানোর গল্প, জোড়া লাগা বাচ্চাদের অস্ত্রোপচার করে আলাদা করার গল্প, লিভার ও বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের মতো জটিল চিকিৎসা ইত্যাদিসহ নানা সফলতার গল্প। এ দেশে কলেরার স্যালাইন, ওরস্যালাইন, করোনাভাইরাস কিট আবিষ্কারের ইতিহাস তুলে ধরুন। প্রথিতযশা চিকিৎসকদের নানা অবদানের কথাও জানাতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। এসব তুলে ধরতে হবে সমাজে, নাগরিকদের কাছে।
মনে রাখতে হবে, শুধু অর্থ বা ব্যক্তিগত ভোগের জন্য কেউ ডাক্তারি পেশায় আসেন না। আসেন মানবসেবার ব্রত নিয়েই। তাঁদের তাই সম্মান করুন। ২০২০ সালের ভয়াবহ করোনা মহামারিতে সম্মুখযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা স্মরণে রাখতে হবে।
দেশের মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি ডাক্তারদের কর্ম, ত্যাগ ও অবদানের কথা না জানে, তাহলে ভবিষ্যতে এ দেশে ডাক্তার রকিবের মতো অনেককেই এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। ডাক্তারদের জন্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের পাশাপাশি মানুষের মনে শুভবোধের উদয় হোক। ডা. রকিবসহ সব শহীদ করোনাযোদ্ধার বিদেহী আত্মার শান্তি হোক। এ জাতি তাদের অবদান মনে রাখবে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে।
দূর হোক সব অন্ধকার, মঙ্গলময় হোক সবার জীবন।
*চিকিৎসক, সেগুনবাগিচা, ঢাকা। [email protected]