বর্তমান সরকার আমলের দুবারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ৮৪তম জন্মদিন আজ বুধবার। ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ছিলেন তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের কর্ণধার এবং পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা। মা সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীও সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে। ১৪ ভাইবোনের মধ্যে মুহিতের অবস্থান তৃতীয়।
জীবনের এতটি বছর পেরিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র তথা আগামী দিনের বাংলাদেশ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, ‘আমার তিরাশি বছর শেষ হচ্ছে, চুরাশিতে পা দিতে যাচ্ছি। জীবনটা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। বলা যায় উন্নত মানের সন্তুষ্ট। কারণ, এ দেশের উন্নয়নে আমার চিন্তা ও দর্শনের প্রতিফলন আছে এবং এ দেশের উন্নয়নের আমিও একজন নীতিনির্ধারক।’
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আবদুল মুহিত বরাবরই একজন মেধাবী মানুষ। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তার আগে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী এবং হতাশা আমাকে কখনোই গ্রাস করে না। এর চেয়ে সন্তোষজনক ও সুখকর অনুভূতি একজন মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে আমি জানি না।’
সচিবালয় থেকে গতকাল মঙ্গলবার গাড়িতে করে তাঁর হেয়ার রোডের সরকারি বাসায় যাওয়ার পথের পুরোটা সময় বেশ খোশমেজাজে ছিলেন আবদুল মুহিত। এ সময় স্মৃতিচারণা করেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের কথা। ‘১১-১২ বছর থেকেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে মনে। তারপর পাকিস্তান হলো। কিন্তু বিমাতাসুলভ আচরণে আমরা আশাহত হলাম। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ।’
সিএসপিতে যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষও ত্যাগ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো। এবার শুরু হলো আরেক যুদ্ধ। এ যুদ্ধেরও সামনে বঙ্গবন্ধু। এবারের যুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ। এগিয়েও চলছিলাম আমরা।
মাঝখানে একধরনের সামরিক শাসনের (কাইন্ড অব মার্শাল ল) কারণে অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। তারপর তো বর্তমান অবস্থা। আশা করছি, ২০২৪ সালের মধ্যেই আমরা উন্নয়নের সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলব।’
কীভাবে সম্ভব হবে—জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘চোখের সামনে উন্নতির বড় উদাহরণ হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। একটা ডেসপারেট কান্ট্রি। কোরিয়া পেরেছে, আমরাও পারব।’
দেশের নারীদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী মুহিত। বলেন, ‘এটা গৌরবের বিষয় যে প্রাথমিক পর্যায়ে তো বটেই, মাধ্যমিক পর্যায়েও নারী শিক্ষার্থীরা এখন ছেলেদের সমান। সরকারি চাকরিতেও নারী প্রায় ৩০ শতাংশ।’
এক ফাঁকে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হককে। বলেন, ‘এই লোকটি আমার পছন্দের ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তানে তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। বাংলাদেশ অঞ্চলে অবশ্য তিনি মোটেই জনপ্রিয় ছিলেন না। তাঁর অনেক গুণ ছিল। যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারলে নিজের বিশ্বাস থেকেও তিনি সরে আসতে পারতেন।’
গাড়িতে স্বল্প সময়ের মধ্যে শিল্প, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র নিয়েও কথা বলেন মুহিত। প্রিয় চলচ্চিত্রের নাম জানতে চাইলে তাৎক্ষণিকভাবেই বলেন, ‘রোমান হলিডে। এই ছবিটাই সবচেয়ে বেশিবার দেখেছি। আর সুচিত্রা সেন অভিনীত সব ছবি।’ ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া মার্কিন রোমান্টিক কমেডি চলচ্চিত্র রোমান হলিডেতে বিশ্ববিখ্যাত অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন অভিনয় করেন।
সুযোগ পেলেই প্যারিসে লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি ‘মোনালিসা’কে দেখতে যান বলে জানান অর্থমন্ত্রী। বলেন, ‘ভিঞ্চি এমন একটি মেয়েকে আঁকলেন এবং এমনভাবে আঁকলেন যে ছবিটার দিকে তাকালেই মনে হয় আমার দিকে চেয়ে হাসছে এবং আমার জন্যই হাসছে।’
প্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধ, আত্মজীবনীসহ এযাবৎ তিনি ২৯টি বই লিখেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বিদেশে গেলে চিত্রকর্ম দেখা এবং নতুন নতুন খাবার চেখে দেখার অভ্যাস আছে তাঁর।
গুনগুন করে গান করেন কি না জানতে চাইলে একটু চমকে ওঠেন তিনি। হাসতে হাসতে বলেন, ‘এটা আর হয়ে ওঠে না। ছোটবেলায় ছেড়েছি। তবে গান শুনি।’
স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ‘ভালো আছি’ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হবে এক দৃপ্ত অহংকারের নাম—এই স্বপ্নে বাকি জীবন বেঁচে থাকতে চাই।’