'জামায়াতমুক্ত' করতেই ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তন
জামায়াতমুক্ত করতেই ইসলামী ব্যাংকে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যাংকটিকে জামায়াতমুক্ত করতে আগে থেকেই উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৬ সালের জুন থেকে। ২ জুন ব্যাংকটির ৩৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় নতুন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য নতুন নতুন কোম্পানি তৈরি করে ব্যাংকটির পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। আর গত বৃহস্পতিবার জামায়াত-সংশ্লিষ্ট ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিনিধি হিসেবে চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ারের পদত্যাগের মাধ্যমে ব্যাংকটির পর্ষদ পুরো জামায়াতমুক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নতুন পরিচালকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতমুক্ত করতেই ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনে এস আলম গ্রুপের নাম শোনা গেছে। যদিও ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয়েছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে।
যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গ্রুপটির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান।
এদিকে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পর গতকাল উৎসুক মানুষ ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেছিলেন। প্রধান কার্যালয়ে শুক্রবার ছুটির দিনও অফিস করেছেন কিছু কর্মকর্তা। শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। নতুন নেতৃত্ব ১২ ও ১৩ জানুয়ারি সোনারগাঁও হোটেলে সব শাখার প্রধানদের সম্মেলনে দিকনির্দেশনা দেবেন, যাতে তুলে ধরা হবে পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য। ব্যাংকটি কীভাবে চলবে তারও নির্দেশনা দেওয়া হবে শাখাপ্রধানদের।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসনে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় আরমাডা স্পিনিং মিলের পক্ষে পরিচালক হিসেবে আরাস্তু খান যোগ দেন। এরপরই চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের পদত্যাগপত্র উপস্থাপন করেন। এরপর তিনিও চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পরই মুস্তাফা আনোয়ার সভা থেকে বের হয়ে যান। এরপরই কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আরাস্তু খানকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞাকে নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি ব্যাংকের কোম্পানি সচিব হিসেবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কোম্পানি সচিব জাহিদুল কুদ্দুস মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
যোগাযোগ করা হলে আরাস্তু খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকালই (বৃহস্পতিবার) আমি পরিচালনা পর্ষদের সভায় প্রথম যোগ দিয়েছি। ওই সভাতেই আমাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।’
তবে বৃহস্পতিবারের বড় এই সিদ্ধান্তের সময় উপস্থিত ছিলেন না আল-রাজীর প্রতিনিধি পরিচালক ইউসিফ আবদুল্লাহ আল-রাজী ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রতিনিধি আরিফ সুলেমান। যদিও পর্ষদের সভায় ইউসিফ আবদুল্লাহ আল-রাজীকে ভাইস চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২২ মে ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় আবু নাসের আবদুজ জাহের তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত হলে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে ২০১৫ সালের ১৩ জুন ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় মুস্তাফা আনোয়ারকে তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান করা হয়।
২০১০ সালের মে মাস থেকে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। আগামী জুনে এমডি পদে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। যোগাযোগ করা হলে আবদুল মান্নান গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভালো আছি।’ এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ মূলত এস আলম গ্রুপের আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট মালিকানা ও নথিপত্রের বিষয়টি দেখভাল করেন। আবার ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল আলম। তিনি মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ভাই। ইউনিয়ন ব্যাংকের যাত্রার শুরুর দিকে আবদুল হামিদ মিঞাকে ব্যাংকটির এমডি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে আবদুল হামিদ রূপালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন। বৃহস্পতিবারই নতুন এমডি নিয়োগের অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠায় ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মালিকানায় এস আলম গ্রুপেরও অংশ আছে। ব্যাংকটি সরকারি-বেসরকারি খাতের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি এ এ এম জাকারিয়া বর্তমানে ব্যাংকটির পরিচালক। গত বছরের জানুয়ারিতেই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে আরাস্তু খানকে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে গত ১৫ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তাঁকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গত বৃহস্পতিবার পরিচালক হিসেবে প্রথম সভায় যোগ দিয়েই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আরাস্তু খান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আইনকানুন মেনে, যথাযথ অনুমোদন নিয়ে এ পরিবর্তন হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আরাস্তু খানকে চিনি। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন ব্যাংকটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করি না।’ এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।
ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় গ্রাহকও চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। ২০১৫ সালে ব্যাংকটিতে গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণ ছিল ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ শেষে তা প্রায় ৪ হাজার কোটির কাছাকাছি পৌঁছেছে। গ্রুপটির মালিকানায় রয়েছে খাদ্য, সিমেন্ট, স্টিল, বিদ্যুৎ, পরিবহন, শিপিং, কৃষি ও গণমাধ্যমের কমপক্ষে ৩০ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ৬টি ব্যাংক ও একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অংশের শেয়ারের মালিক গ্রুপটি।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে ওই প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধনের কমপক্ষে ২ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। গত এক মাসের গড় বাজারমূল্য হিসেবে ২ শতাংশ শেয়ারের মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে গত এক বছরে যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন, তাঁদের পরিচয় নিয়েই রয়েছে নানা প্রশ্ন। সবশেষ বস্ত্র খাতের স্বল্প পরিচিত প্রতিষ্ঠান আরমাডা স্পিনিং মিলস ইসলামী ব্যাংকের ২ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনেছে। আরমাডা স্পিনিং মিলের কর্ণধার জনৈক মো. আরশেদ বলে নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনেরও সদস্য নয়। তাদের কোনো ওয়েবসাইটও নেই।
সূত্র জানায়, গত এক বছরে শেয়ার কিনে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধি দিয়েছে এবিসি ভেঞ্চার, গ্র্যান্ড বিজনেস লিমিটেড, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, প্লাটিনাম এনডেভরস, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল ও ব্লু ইন্টারন্যাশনাল। এদের সবার ঠিকানা চট্টগ্রামে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প পরিচিত। এ ছাড়া নিয়োগ দেওয়া আটজন স্বতন্ত্র পরিচালক।
গত বৃহস্পতিবার আজিজুল হক পদত্যাগ করায় স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে আছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল, পূবালী ব্যাংকের সাবেক (এমডি) হেলাল আহমেদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি জিল্লুর রহমান, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবদুল মাবুদ, আইনজীবী বোরহান উদ্দিন আহমেদ এবং বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাইনপুকুর সিরামিক ও নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। এ ছাড়া শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদে আছেন বিদেশি আল-রাজী, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সরকারি খাতের ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে না। এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুমোদন লাগবে। নিশ্চয়ই তারা এর অনুমোদন নেবে।
এদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা কী প্রতিক্রিয়া দেখান, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামীকাল রোববার পর্যন্ত। ব্যাংকটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার সবশেষ লেনদেন হয়েছে ৩০ টাকায়।
এ বিষয়ে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদের ডিন মোহাম্মদ মূসা প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের একসঙ্গে এত বড় পরিবর্তন আইনসংগত। তবে পরিবর্তনটি অস্বাভাবিক। সাধারণত ব্যাংকগুলোতে একসঙ্গে এত বড় পরিবর্তন দেখা যায় না। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা নিশ্চয়ই একটা প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। তবে সেটা ইতিবাচক না নেতিবাচক, তা সময়ই বলে দেবে।
এদিকে বৃহস্পতিবারের পর্ষদ সভায় ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক সচিব সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ব্যাংকটির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল ও জাকাতের আদায়কৃত অর্থ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ব্যয় হয়। এর সুবিধাভোগী নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও সমর্থকেরাই এ থেকে সহায়তা পান বলে অভিযোগ রয়েছে।