'কেউ আমাকে একটি চাকরি দেবেন?'
জন্মের পর আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত চোখে আলো ছিল। তারপর টাইফয়েড জ্বরে দুই চোখের আলো নিভে যায়। দৃষ্টিহীন চোখের সামনে এখন কেবলই লাল, সাদা বা কালো একটা ছায়া। মায়ের মুখ, স্বামীর মুখ, ছেলেমেয়ের মুখ বা বলতে গেলে মানুষ দেখতে কেমন হয়, তা জানার কোনো উপায় নেই ৪২ বছর বয়সী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রোজিনা বেগমের।
জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফজলে রাব্বীকে বিয়ে করেছিলেন রোজিনা। স্বামী বয়সে বেশ ছোট এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে রোজিনার সঙ্গে তাঁর বিস্তর ব্যবধান। স্বামীর মনোভাব ছিল সন্দেহবাতিক। ছিলেন নেশাগ্রস্তও। এসব কারণে সুখ না থাকলেও ১৫ বছর কাটিয়ে দেন স্বামীর সঙ্গে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে ফারিহা জাহান এবং পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাফিউন রাফিকে নিয়ে ছিল সংসার। গত বছরের মার্চ মাসে স্বামী হঠাৎই মারা যান। এখন দুই সন্তান নিয়ে রোজিনা বেগমের দিশেহারা অবস্থা।
রোজিনা বেগমের চোখে আলো না থাকলেও কণ্ঠে সুর আছে। স্বামীও স্প্যানিশ গিটার বাজাতেন। বলতে গেলে সুরে সুরেই পরিচয় হয়েছিল স্বামীর সঙ্গে। এখন স্বামী নেই। দুই সন্তান নিয়ে রোজিনা ঠাকুরগাঁওয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকছেন। সেখানে তিনজনের তিন বেলা খাবার হয়তো জুটছে, কিন্তু এই বাড়তি বোঝা কেইবা কত দিন টানতে চায়? তাই পরিবারের সদস্যরা যখন রোজিনার সন্তানদের অবহেলা করেন, তা সহ্য করতে পারেন না। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। তিন বেলা খাবারের বাইরে তিনজন মানুষের অনেক চাহিদা। তাই রোজিনার কণ্ঠে আকুতি, ‘কেউ আমাকে একটি চাকরি দেবেন?’ সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘আমি কিন্তু একা চলাচল করতে পারি। আমি গানের টিউশনি করি। বিভিন্ন মঞ্চে গান গাই। কিন্তু এই করে তো আর ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারব না। তাই আমার চাকরির খুব দরকার। যেকোনো গানের স্কুলেও যদি একটি চাকরি হতো, তাহলে ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনোভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম।’
সম্প্রতি প্রথম আলো কার্যালয়ে বসেই কথা রোজিনা বেগমের সঙ্গে। ছেলে ও মেয়ে সঙ্গেই ছিল। ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকায় মায়ের বাসায় আসার একটিই উদ্দেশ্য, কোনোভাবে যদি একটি চাকরির সন্ধান পাওয়া যায়।
রোজিনা রাজধানীর আগারগাঁও সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন। তখন এই কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করার ব্যবস্থা ছিল না। তাই আর করা হয়নি। এরপর কলেজটিতে স্নাতকোত্তর চালু হলেও সে সুযোগ মেলেনি। স্বামী ছিলেন এইচএসসি পাস। তিনি অষ্টম শ্রেণি থেকেই মাদকাসক্ত ছিলেন।
রোজিনার বাবা মারা গেছেন। মা চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। বড় ভাই সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। আরেক ভাই ব্যক্তিগত গাড়ির চালক। বয়স বা শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যবধান থাকলেও রোজিনার পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন, ছেলেমেয়ের জানাশোনা আছে, বিয়ে হলে হয়তো সুখেই থাকবেন মেয়ে। রোজিনা পরিবারের কাছে স্বামীর মাদকাসক্তির কথা চেপে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি।
রোজিনা ঢাকা-গাজীপুরে একাই যাতায়াত করে চার বছর অ্যাসিসটেন্স ফর ব্লাইন্ড চিলড্রেন নামক সংগঠনে প্রুফ রিডারের চাকরি করেছেন। রাজধানীর মিরপুরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং বর্তমানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে গানের শিক্ষকতা করেছেন। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রে জুনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার পদে চাকরি করেছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে কাগজে-কলমে এই পদে চাকরি হলেও কাজ করেছেন টেলিফোন অপারেটর হিসেবে। বিয়ের পর থেকে রোজিনা যেখানেই চাকরি করেছেন, পুরো বেতন তুলে দিতে হতো স্বামীর হাতে।
রোজিনা বলেন, ‘যেদিন বেতন হতো, স্বামী আমার সঙ্গে যেতেন। বেতন তুলে পুরো টাকা দেওয়ার পর তা নিয়ে স্বামী বাড়ি ফিরতেন। নিজের মতো খরচ করতেন। তাই এ জীবনে সঞ্চয় বলে কিছু করতে পারিনি। তারপর মেয়ে ছোট, তাকে কে দেখবে, সে অজুহাত দিতে থাকেন স্বামী।’ রোজিনাকে তাই চাকরি ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠতে হয়। তারপর স্বামীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঘরের চার দেয়ালের ভেতরেই জীবন কাটে। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা বা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধের পথে।
রোজিনা বললেন, ‘স্বামী মারা গেছেন, তাই তাঁর সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে আমারই খারাপ লাগছে। কিন্তু মানুষটা বিয়ের পর কিছুদিন এবং মারা যাওয়ার আগে কিছুদিন ছাড়া সুখ দেননি। শারীরিক নির্যাতন কম করেছেন, কিন্তু চাহিদামতো নেশার টাকা না দিলেই ঘরের জিনিস ভাঙচুর করতেন। মঞ্চে গান গাওয়া বা কোনো চাকরির জন্য যেতে দিতেন না। সারাক্ষণ সন্দেহ করতেন। হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। স্বামী ভালো স্প্যানিশ গিটার বাজাতেন, আমি শিখতে চাইলেও কখনোই শেখাননি।’
রোজিনা বেগম জানালেন, বেসরকারি টেলিভিশনে গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ‘ক্লোজআপ ওয়ান’–এ অডিশন থেকে সিলেকশন রাউন্ড পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। অন্য আরেকটি টেলিভিশনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের গানের অনুষ্ঠান ‘অন্য আলো’তে প্রথম ১৬ জনের মধ্যে জায়গা করে নেন। কিন্তু পরে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ এই প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ বেতারের ‘সি’ গ্রেডের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী। তবে শিল্পীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এক থেকে দেড় বছরে হয়তো একটি গান গাওয়ার সুযোগ মেলে। একটি গানের জন্য পান ৬০০ টাকা।
রোজিনা আরও জানালেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করেছেন। ছেলে তার বাবার মতো স্প্যানিশ গিটার বাজাতে পারে। আর মেয়ে মায়ের গান শুনে শুনেই ভালো গাইতে পারে। মঞ্চে মা কোনো জায়গায় আটকে গেলে এই মেয়েই মাকে উদ্ধার করে।
ঠাকুরগাঁওয়ে রোজিনা গানের টিউশনি করেন। তবে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার আগে, রমজানের সময় এসব টিউশনি বন্ধ রাখতে হয়। টিউশনি সব সময় পাওয়া যায় না।
স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে শ্বশুর তিনবেলা তিনজনকে খাবার দেওয়ার ছাড়াও মাসে দুই হাজার টাকা দেন। কিন্তু এই টাকায় ছেলেমেয়েদের তো আর পড়ার খরচ চালানো সম্ভব না। শ্বশুর তাঁর অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
রোজিনা বলেন, ‘ছেলে জীবিত থাকা অবস্থাতেই আমাকে মেনে নিতে চাইতেন না শ্বশুরবাড়ির লোকজন। স্বামী কোনো কাজ করতেন না। মা-ভাইদের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে স্বামীর হাতে দিতে হতো। সেই টাকা দিয়ে তিনি নেশা করতেন। এখন তাঁদের ছেলে নেই। আমিও তাঁদের কোনো উপকারে আসতে পারছি না। তাই আমার কদর কেউ করবে না, তা–ই তো স্বাভাবিক। আর আমি নিজেও অন্যের ঘাড়ে বসে খেতে চাই না। আমার গলায় সুর আছে। শরীরে শক্তি আছে। কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তাই কেউ যদি আমাকে একটি চাকরি দেন, আমার ও ছেলেমেয়েদের জীবনটা অন্য রকম হতে পারবে।’
ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকায় আসার পথে ঠান্ডা লেগেছে। ঢাকায় আসার আগে শীতের রাতে একটি মঞ্চে গান গেয়েছেন। গলা বসে গেছে। তারপরও প্রতিবেদকের অনুরোধে কয়েকটি গান গাইলেন রোজিনা। তবে শুরু করলেন স্বামীর লেখা একটি গান দিয়ে।
স্বামী ভালো ছিলেন না, তারপরও স্বামীর লেখা গান দিয়েই শুরু করলেন, তা জানতে চাইতেই হেসে দিলেন রোজিনা। বললেন, ‘ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিলাম। সেও আমাকে ভালোবাসত। সারাক্ষণ ভয়ে থাকত আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব। সবকিছু মিলে তো ১৫ বছর তার সঙ্গেই কাটিয়েছি।’