'এটি দ্বিতীয় জীবন লাভ'
নাম তাঁর আর্থ কিশোর। বয়সে তরুণ। অন্যের জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়েছেন ২৬ বার। প্রথম আলোর ভৈরব বন্ধুসভার সক্রিয় সদস্য। শরীর থেকে করোনাভাইরাসকে বিদায় করে গত বুধবার দুপুরে তিনি হাসপাতালের ছাড়পত্র পেয়েছেন।
১৩ এপ্রিল আর্থ কিশোরের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়ে। তিনি হলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আক্রান্ত ৪৩ জনের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি। ওই দিনই তাঁকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টানা দুই সপ্তাহ হাসপাতালের চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে করোনার সঙ্গে লড়াই করেছেন। চোখের সামনে দেখেছেন মানুষের করুণ মৃত্যু আর বহু আক্রান্ত ব্যক্তির করোনা দুর্ভোগ।
বুধবার বেলা একটার দিকে ছাড়পত্র হাতে পাওয়ার পরই প্রথম আলোকে আর্থ কিশোরের ফোন। গলা কাঁপছে আর্থের। বলছিলেন, তিনি ভালো হয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে, এটি তাঁর দ্বিতীয় জীবন লাভ। হাসপাতালের প্রতিটি দিন তাঁর কাছে শ্বাসরুদ্ধকর মনে হয়েছে। এ যেন জয় পেতে শেষ ওভারের শেষ বলের মতো।
আর্থ পেশায় ওষুধ ব্যবসায়ী। ভৈরব বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তাঁর ওষুধের দোকান রয়েছে। বাড়ি পৌর শহরের ভৈরবপুর উত্তরপাড়ায়। সদা হাসিখুশি মানুষটি নিজে হাসেন, অন্যদেরও হাসাতে পছন্দ করেন। করোনার প্রথম দিনগুলোতে যখন বাজারে মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার উচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছিল, তখন তিনি অন্যদের মতো অতি মুনাফা না করে ন্যায্য দামে বিক্রি করেন।
১৩ এপ্রিল রাতে প্রিয়জনদের বাড়িতে রেখে অন্ধকারাচ্ছন্ন নীরব মহাসড়ক দিয়ে ঢাকার পথে আর্থ যখন একা যাত্রা করেছিলেন, তখন তিনি অ্যাম্বুলেন্সে বসে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ‘জীবনের দামে হলেও ভালো থাকুক আমার শহর’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়ে ভৈরববাসীকে কাঁদান। এই পোস্টের মাধ্যমে করোনার মোকাবিলায় সবাইকে সচেতন হতে অনুরোধ করে বলেন, ‘আমি এত সতর্ক থেকেও, এত পরিচ্ছন্ন থেকেও, এত নিরাপত্তা নিয়েও নিজেকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি, সুতরাং আপনারা নিজেদের হিসেব নিজেরা মিলিয়ে নিন।’ তাঁর এই পোস্টে বহু মানুষ মন্তব্য করে সমবেদনা জানান। তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষা করেন।
এই দিন আর সেই দিনের অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে আর্থ জানালেন, কোনো ঘটনা দিয়েই সেই সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরা সম্ভব নয়। শরীরে করোনা ভর করেছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তার মাধ্যমে তথ্যটি জানার পর মুহূর্তে চেনা চারপাশ তাঁর কাছে অচেনা হয়ে পড়তে থাকে। ঘরের মানুষ ছাড়া অন্য সবার সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব আরও বাড়ে। তবে ওই সময়টাতে তাঁর জন্য ভৈরববাসী ও স্বজনদের ভালোবাসা চরম পাওয়া বলে মনে করেন আর্থ। আর হাসপাতালের চার দেয়াল থেকে ছুটি পাওয়ার পর প্রথম আকাশটা ভালো করে দেখলেন। এরপর শুরু বাড়ি ফেরার অপেক্ষা। হাসপাতালের সময়টার সব অভিজ্ঞতা নতুন। বিশেষ করে চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ভালো নয় বলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
পরিশেষে আর্থ বলেন, কোনোভাবেই করোনাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি কম থাকলেও সামাজিক ঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েক গুণ।