৬৪% নারী কর্মী দালালদের টাকা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যান
বিনা খরচে মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার কথা থাকলেও তা পারছেন না নারী গৃহকর্মীরা। ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা বাগিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালেরা। আর কর্মী পাঠাতে নানা ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নিচ্ছেন তাঁরা। বয়স লুকিয়ে ও নকল সনদ সরবরাহ করে নারী গৃহকর্মীদের পাঠানো হচ্ছে সেখানে। বিদেশে নির্যাতিত হয়ে চুক্তির আগেই দেশে ফিরে আসছেন অনেকে।
দেশে ফিরে আসা নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশ নারী গেছেন দালালের (সাব-এজেন্ট) মাধ্যমে। এঁদের ৬৫ শতাংশের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন দালালেরা। নানা কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসা ফরিদপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার ২৬২ জন নারী কর্মীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়েছে। ৪ এপ্রিল গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে পাঠাতে বেশির ভাগ নারীর কাছ থেকে দালাল টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ২ শতাংশের কাছ থেকে ১ লাখ টাকার বেশি নেওয়া হয়েছে। ২০ শতাংশ নারী ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। ২৮ শতাংশ নারী ২০ থেকে ৫০ হাজার ও ১৫ শতাংশ নারী ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন বিদেশে যেতে।
নারী গৃহকর্মীদের মধ্যপ্রাচ্য যেতে কোনো টাকা লাগার কথা নয়। পদে পদে নানা অনিয়ম করে পাঠানো হচ্ছে কর্মী।
মুন্সিগঞ্জের আছিয়া প্রথম আলোকে জানান, ভালো নিয়োগকর্তা বা কফিল পাওয়ার আশায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করে সৌদি আরব যান। কিন্তু এক বছর পর তাঁর ইকামার (কাজের বৈধ অনুমতিপত্র) মেয়াদ বাড়াননি নিয়োগকর্তা। এরপর মেসে থেকে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেছেন। বয়স বেশি হওয়ায় নিয়মিত কাজ পেতেন না। করোনার সময় বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরে আসেন।
জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, বিশ্বের ১৭টি দেশে কাজ করতে যান নারী কর্মীরা। এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ নারী যান মধ্যপ্রাচ্যে। আর মোট কর্মীর ৪০ শতাংশই যান সৌদি আরব। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হলেও নারী কর্মীর যাওয়া বাড়তে শুরু করে ২০১৫ সাল থেকে। এরপর থেকে বছরে এক লাখ নারী যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। ওকাপের গবেষণা বলছে, এক বছরের মধ্যেই ফিরে এসেছেন ৫৮ শতাংশ।
তৃণমূল পর্যায়ে অভিবাসীদের নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওকাপ। ফিরে আসা প্রবাসীদের পুনরেকত্রীকরণ, ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা প্রদান, আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা, মানব পাচার প্রতিরোধ ও বিদেশে যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ অভিবাসীদের নানা সহায়তা দিয়ে থাকে সংস্থাটি।
ওকাপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কর্মী পাঠাতে নানা অনিয়মের কারণে বেশি হারে ঝুঁকি তৈরি হয়। এটি বন্ধ করতে হলে দালালদের বৈধ প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। এরা রিক্রুটিং এজেন্সির হয়ে কাজ করে। তাই এজেন্সিকে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
৬০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার
মাত্র ২ মাস ৯ দিন পর সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন নরসিংদীর নাহিদা (ছদ্মনাম)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নিয়োগকর্তা ও তাঁর ছেলে নিয়মিত যৌন নির্যাতন করতেন। মাঝেমধ্যে ভাই-ভাগনে-ভাতিজাদের দাওয়াত করে তাঁদের দিয়ে নির্যাতন চালাতেন। দেশে দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা মুখ বুঝে সহ্য করার পরামর্শ দেন। অথচ ভালো নিয়োগকর্তা পাওয়ার আশায় ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন দালালকে। অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করে স্বামী দেশে ফিরিয়ে আনেন তাঁকে।
এই নারী বলেন, দেশে ফিরতে তিন শতাংশের ভিটা থেকে দুই শতাংশ বিক্রি করতে হয়েছে।
ওকাপের জরিপ বলছে, ফিরে আসা নারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বাড়তি মজুরি ছাড়া ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করানো, অন্য স্বজনের বাসায় কাজ করতে পাঠানো, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নিয়মিত খাবার না দেওয়া। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাঁরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, বয়সের নকল সনদ
বিদেশে যেতে ২১টি রোগের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। এসব পরীক্ষায় আনফিট হয়েও নকল সনদ দেখিয়ে বিদেশে গেছেন ১৭ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশে যাওয়ার আগে নারী কর্মীর জন্য এক মাসের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। কিন্তু কোনো প্রশিক্ষণে অংশ না নিয়ে বা কোনোরকমে অংশগ্রহণ করে সনদ পেয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। গবেষণায় প্রশিক্ষণ ছাড়া ২৪ শতাংশ নারীকে সনদ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ঘটনা পাওয়া গেছে।
দুই সপ্তাহ আগে সৌদি আরব থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তানিয়া (ছদ্মনাম)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২ বছর ৮ মাস আগে তিনি বিদেশে যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। দালাল ২৫ হাজার টাকা নিয়ে বয়স ২৫ দেখিয়ে পাসপোর্ট করে দিয়েছেন।
সরকারি নিয়ম বলছে, ২৫ থেকে ৩৮ বছর বয়সী নারীরা কাজ নিয়ে বিদেশে যেতে পারবেন। গবেষণায় নির্ধারিত বয়সসীমার মধ্যে ৭৭ শতাংশ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ শতাংশের বয়স ৩৮-এর চেয়ে বেশি। আর ১০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। আর ৩ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
নিপীড়নের শুরুটা দেশ থেকেই
গবেষণায় ৪৩ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, নিপীড়নের শুরুটা হয়েছে দেশে থাকতে দালালের মাধ্যমেই। ৮৮ শতাংশ নারী চাকরির কোনো চুক্তিনামা পাননি। ৪৫ শতাংশ নারী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন পাননি। বিদেশফেরত এসব নারীর মধ্যে ২১ শতাংশ তালাকের শিকার হয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচারের আশায় ওকাপের কাছ থেকে ২০১৯ সালের বিভিন্ন সময়ে আইনি সহায়তা নেন এই নারীরা।
অভিবাসী কর্মীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে ওকাপ। এর মধ্যে রয়েছে অভিবাসন আইন সংশোধন করে দালালদের নিবন্ধনের আওতায় আনা, ভুক্তভোগী প্রবাসী ও তাঁদের পরিবারের সাক্ষ্য নিরাপত্তা, অভিবাসী কর্মীদের মামলা মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করা, কর্মীদের অভিযোগ সালিসের বিষয়টি বিএমইটি থেকে সরিয়ে নেওয়া।