৬৪ জেলার ৪৩টিতেই করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র নেই
দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৩টিতেই করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। এসব জেলা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার জন্য কাছের জেলায়, কিছু ক্ষেত্রে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। এতে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে চাপ বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে নমুনাজট। অন্যদিকে পরীক্ষার ফল জানতে সময়ও বেশি লাগছে। অনেক ক্ষেত্রে সংগৃহীত নমুনা সঠিক পদ্ধতিতে পরিবহন না করায় তা অকার্যকর বা বাতিলও হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের ৬২টি কেন্দ্রে কোভিড-১৯ শনাক্ত–করণের পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৩২টি এবং ঢাকার বাইরে ৩০টি। এর বাইরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করা যায়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দেড় মাসে ঢাকায় নতুন যুক্ত হওয়া ১৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৪টিই বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বেসরকারিভাবে পরীক্ষা করাতে সরকার নির্ধারিত খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকা। ফলে সরকারি কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষার চাপ বাড়ছে।
নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সফরে আসা চীনের বিশেষজ্ঞরাও। গতকাল সোমবার চীনে ফিরে যাওয়ার আগে প্রতিনিধিদলটি তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানায়, ঢাকার বাইরে ল্যাব কম। সে জন্য নমুনা ঢাকায় পাঠিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়। যত বেশি সম্ভব নমুনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে চীনের বিশেষজ্ঞরা জানান, দ্রুত পরীক্ষা, দ্রুত শনাক্তকরণ, দ্রুত সঙ্গনিরোধ ও দ্রুত চিকিৎসার কারণে উহানে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। করোনা মহামারির শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগের পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও পরীক্ষার সংখ্যা ও আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। শুরু থেকেই দেশে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা কম হওয়া নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।
দেশে গতকাল পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৮৬ জনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। এই সময় পরীক্ষা যত বেশি হবে, আক্রান্ত ব্যক্তিও তত বেশি শনাক্ত হবে। এতে একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে, অন্যদিকে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে।
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, লক্ষাধিক কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী রয়েছে, এমন ১৮টি দেশের মধ্যে মেক্সিকোর পরে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে। অন্যদিকে বিশ্বের ২১৫টি দেশের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ে যত দ্রুত সম্ভব আরটিপিসিআর পরীক্ষা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয়ের জন্য যন্ত্রপাতি ও সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি সহজে করা যায়, এমন নতুন নতুন পরীক্ষা চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
৪৩ জেলায় নেই পরীক্ষাকেন্দ্র
ঢাকাসহ দেশের ২১টি জেলায় করোনা শনাক্তকরণের পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার মধ্যে ৫ জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় ৩২টি এবং নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে দুটি করে কেন্দ্র রয়েছে। এ দুই জেলায় করোনার সংক্রমণও বেশি। কিশোরগঞ্জ ও ফরিদপুরে একটি পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে পাঁচটি পরীক্ষাকেন্দ্র। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে চট্টগ্রাম বাদে নোয়াখালী, কুমিল্লা ও কক্সবাজারে পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরীক্ষাকেন্দ্রের তালিকায় গতকাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম নেই।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। সিলেট বিভাগের দুটি পরীক্ষাকেন্দ্রই সিলেট জেলায় অবস্থিত। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মধ্যে রংপুর ও দিনাজপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী ও বগুড়ায় দুটি করে এবং সিরাজগঞ্জে একটি পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।
ময়মনসিংহ বিভাগে ময়মনসিংহ ও জামালপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। তবে কারিগরি ত্রুটির কারণে জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে গত ২৭ মে থেকে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
বরিশালের ছয় জেলার জন্য একটি কেন্দ্র
বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার জন্য মাত্র একটি পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। একমাত্র পরীক্ষাকেন্দ্র বরিশালের শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজের দৈনিক পরীক্ষার সক্ষমতা ১৮৮টি, যা শুধু বরিশাল জেলার জন্যই পর্যাপ্ত নয়। ফলে করোনা পরীক্ষা করাতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে এসব জেলার বাসিন্দাদের।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসে বরিশাল বিভাগে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। গত শনিবার পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ১৮ জনের। বিভাগের বিভিন্ন জেলার নমুনা পরীক্ষা করতে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। এতে পরীক্ষার ফলাফল পেতে অনেক বেশি সময় লাগছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচ দিন লাগছে।
করোনা শনাক্তকরণের নমুনা সংগ্রহের পর সেটি ভাইরাস ট্রান্সপোর্ট মিডিয়ায় (ভিটিএম) ভরে কুল বক্সে (শীতল বক্স) করে পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠাতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ভিটিএম না থাকায় সাধারণ স্যালাইনে সোয়াব স্টিক ডুবিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। দূরের পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানোর সময় অনেক ক্ষেত্রে স্যালাইন বের হয়ে নমুনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বরগুনা সদর হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা একজন চিকিৎসক নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বরগুনা থেকে সংগ্রহ করা নমুনা ঢাকার মহাখালীর একটি বেসরকারি পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। তিনবার বরগুনার শতাধিক নমুনা বাতিল করেছে ঢাকার প্রতিষ্ঠানটি। নমুনা পাঠিয়ে ফলাফল পেতে দীর্ঘ সময় লাগছে।
বন্ধ থাকছে কেন্দ্র
এখন পর্যন্ত এক দিনে দেশে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ জুন, ১৭ হাজার ৫২৭টি। কেন্দ্রভিত্তিক পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয়টি কেন্দ্রে পরীক্ষা বন্ধ থাকছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, সরকার জেলা পর্যায়ে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করার পর্যাপ্ত সময় পেলেও তা কাজে লাগায়নি। এখন কালক্ষেপণ না করে দ্রুত জেলা পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।