সরকারি করোনা হাসপাতাল
৫২% হাসপাতালে আইসিইউ নেই
জেলা হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা থাকলে মৃত্যু কমানো সম্ভব হতো বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা।
নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা লালনি কান্ত (৭৮) করোনা আক্রান্ত হয়ে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সদর হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় লালনিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাজশাহী নেওয়ার পথে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যু হয়।
নওগাঁ সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ইনচার্জ চিকিৎসক শাপলা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক রোগীকে একেবারে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। আইসিইউ সুবিধা না থাকায় অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই তখন কিছু করার থাকছে না। রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
সাত দিন ধরে দেশে প্রতিদিন করোনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে মৃত্যুর সাড়ে ৭৭ শতাংশই হয়েছে আইসিইউ সুবিধা কম থাকা সাত বিভাগে। আর সাড়ে ২২ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে।
দেশে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ১০০টি হাসপাতালের মধ্যে ৫২টিতেই আইসিইউ সুবিধা নেই। এর মধ্যে ৩৫টি হাসপাতালই জেলা সদর হাসপাতাল। মোট আইসিইউর প্রায় ৭৫ শতাংশই ঢাকা বিভাগে, ২৫ শতাংশ বাকি সাত বিভাগে। জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা থাকলে মৃত্যু কমানো সম্ভব হতো বলে মনে করেন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা।
গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা বাড়াতে বলেন তিনি। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও দেন। ১৩ মাসেও জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতি ও পরিকল্পনার ঘাটতিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ স্থাপনের ক্ষেত্রে জনবলসংকট বড় সমস্যা। লোকবল ছাড়া শুধু অবকাঠামো করলে জনগণ কোনো সুবিধা পাবে না। অবেদনবিদসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ধীরে হলেও আইসিইউ স্থাপনের কাজ চলছে।
জটিল রোগীদের যেতে হচ্ছে অন্য জেলায়
শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এর জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জটিল প্রায় সব রোগীর আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি ভেন্টিলেশন দরকার হয়।
আইসিইউ সুবিধা না থাকায় হাসপাতালগুলোতে জটিল করোনা রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি কারও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বা আইসিইউ প্রয়োজন হলে আশপাশের অন্য জেলার হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর এলাকায় মারা যান ব্যবসায়ী বিল্লাল সরদার। তীব্র শ্বাসকষ্ট থাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে পথেই এই রোগীর মৃত্যু হয়। বিল্লাল সরদারের বড় ছেলে সাগর সরদার বলেন, ‘যখন বাবাকে পাঠানো হয়, তখন আর সময় ছিল না। সদর হাসপাতালে আইসিইউ সেবা থাকলে বাবা হয়তো বেঁচে যেতে পারত।’
মাদারীপুরের সিভিল সার্জন মো. সফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ শয্যা দিলেই চালু করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় লোকবল দরকার। লোকবলসহ নানা বিষয়ের চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা মহানগরীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতাল ১৬টি। এর মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় করোনা রোগীদের জন্য ১৪টি হাসপাতাল নির্ধারিত রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিতেই কোনো আইসিইউ নেই। এই হাসপাতালগুলো হলো জিনজিরা ২০ শয্যা হাসপাতাল, মাদারীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলা সদর হাসপাতাল এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরব ট্রমা সেন্টার। এসব জেলায় কোনো রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বা আইসিইউ প্রয়োজন হলে আশপাশের অন্য জেলায় স্থানান্তর করতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত চারটি হাসপাতালের মধ্যে চট্টগ্রাম রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ নেই। চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনীর সোনাগাজীর মঙ্গলকান্দি ২০ শয্যা হাসপাতাল, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ নেই।
রংপুর বিভাগের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল, রংপুরের তাজহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, হারাগাছ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, লালমনিরহাট সরকারি কলেজ (আইসোলেশন সেন্টার) এবং রেলওয়ে হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই।
ঠাকুরগাঁও জেলা হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় প্রতিদিনই চার থেকে পাঁচজন জটিল করোনা রোগীকে দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়। এতে অনেক রোগী পথেই মারা যাচ্ছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থবিষয়ক সম্পাদক রওশন আলী করোনা আক্রান্ত ছিলেন। সম্প্রতি রংপুর নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নাদিরুল আজিজ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখানে আইসিইউ চালুর সিদ্ধান্ত দিয়েছে। গণপূর্ত বিভাগকে আইসিইউর জন্য আলাদা ভবন নির্মাণে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেটা চালু হতে সময় লাগবে।
বরিশাল বিভাগে আইসিইউ শয্যা ২৫টি। এর মধ্যে বরিশালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ২২টি এবং ভোলা সদর হাসপাতালে তিনটি আইসিইউ রয়েছে। ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর ও পটুয়াখালীতে করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ নেই।
খুলনা–রাজশাহী: ১৮ জেলার ১০টিতেই আইসিইউ নেই
কয়েক দিন ধরে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এ দুই বিভাগের ১৮ জেলার মধ্যে ১০টিতেই আইসিইউ সুবিধা নেই।
রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই।
গত বছরের আগস্ট মাসে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দুই মাস আগে আইসিইউ ইউনিটে দুটি শয্যা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এসে পৌঁছালেও এখনো তা স্থাপন করা যায়নি।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ও নওগাঁর সিভিল সার্জন এ বি এম আবু হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ মনিটর ও ভেন্টিলেটর এবং হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা না আসায় এত দিনেও আইসিইউ স্থাপন করা যায়নি।
নাটোর জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। জেলা সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক পরিতোষ কুমার রায় বলেন, আইসিইউর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখান থেকে বলা হচ্ছে এ মুহূর্তে তাঁদের হাতে আইসিইউ নেই। এ ছাড়া নাটোর সদর হাসপাতালে এখনো সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু হয়নি। সেন্ট্রাল অক্সিজেন না থাকলে আইসিইউ চালানো যাবে না।
খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল ও মাগুরা সদর হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
ময়মনসিংহ ও সিলেটে সবচেয়ে কম
সবচেয়ে কম আইসিইউ শয্যা ময়মনসিংহ বিভাগে। এই বিভাগের ময়মনসিংহ জেলায় ১৩টি এবং জামালপুর সদর হাসপাতালে ২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। নেত্রকোনা ও শেরপুর সদর হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা নেই।
সিলেট বিভাগে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২১টি। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ১৬টি ও মৌলভীবাজারে ৫টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতাল, দক্ষিণ সুরমা ও রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং খাদিমপাড়া ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই।
নামে আইসিইউ, কাজে নেই
২৫০ শয্যার কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল ২৭৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে এই হাসপাতালে চারটি আইসিইউ রয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা থাকলেও আনুষঙ্গিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ বলা যাবে না। আইসিইউর বেশ কিছু যন্ত্রপাতি নেই। ভেন্টিলেটর পাওয়া যায়নি। ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে, কিন্তু এখনো সরবরাহ করা হয়নি।’
সব জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ না হওয়াকে সম্পূর্ণভাবে স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতি বলে মনে করেন করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক এই উপাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, এই এক বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী কাজ করেছে? টাকার তো অভাব ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশই প্রতিপালিত হচ্ছে না। করোনা রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একেবারেই মনোযোগ দেয়নি।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]