৫০ বছরে সুশাসন অর্জনে কতটা এগোল দেশ

আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল, বিদ্যমান শাসনপ্রক্রিয়ায় রূপান্তর ঘটিয়ে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যাতে সুশাসন অর্জিত হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।

এ বছর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করছি। এ উপলক্ষে গত ৫০ বছরে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন সম্পর্কে বিভিন্ন ফোরামে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতির পেছনে থাকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ভূমিকা পালনে গভর্ন্যান্স বা শাসনপ্রক্রিয়া সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। তবে শাসনপ্রক্রিয়ার মূলে থাকে ক্ষমতা, যা ব্যবহার করা হয় প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োগ করে; কিছু নিয়ম-পদ্ধতির অনুসরণ করে এবং অনেক প্রতিষ্ঠানকে ক্রিয়াশীল করার মাধ্যমে। আর জনকল্যাণ অর্জনের জন্য প্রয়োজন শাসনপ্রক্রিয়াকে কার্যকর করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

লক্ষ্য ছিল কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের লক্ষ্যও ছিল একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা—যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ আর এ ঘোষণারই প্রতিধ্বনি ঘটেছে আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে, যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’

এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল, বিদ্যমান শাসনপ্রক্রিয়ায় রূপান্তর ঘটিয়ে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যাতে সুশাসন অর্জিত হয়। এটি অনস্বীকার্য যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হলেও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন নির্ভর করে দুই নির্বাচনের মাঝখানে নির্বাচিত সরকার কী করে না-করে তার ওপর। বস্তুত, সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন কার্যকর হয়। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, সুশাসন তথা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচিত সরকার যদি মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, কতগুলো রাজনৈতিক অধিকার বলবৎ রাখে, নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখে, আইনের শাসন নিশ্চিত করে, সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার চর্চা করে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করে এবং সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। নাগরিকের এসব অধিকারের প্রায় সব কয়টিই আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার হিসেবে সুস্পষ্টভাবে বিধৃত আছে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা এগোলো বাংলাদেশ

কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সুশাসনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেক তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ করে থাকে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডম হাউস ও মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন, যুক্তরাজ্যের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, জার্মানির বার্টেলসমান স্টিফটুংয়ের রূপান্তর সূচক (বিটিআই), সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ, জার্মানভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্র।

ফাইল ছবি

গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের বিবেচনায় ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম–সম্পর্কিত বাংলাদেশের স্কোর ২০১৭ সালে ছিল ১০০-এর মধ্যে ৪৭। ২০২১ সালে তা ৩৯-এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের ক্রমাবনতি ঘটছে।

মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন ৩টি ক্যাটাগরিতে—অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সুশাসন ও জনগণের ওপর বিনিয়োগ—১৯টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে, যা লাল ও সবুজ রঙে প্রকাশ করে। সবুজ হলো গ্রহণযোগ্য আর লাল হলো অগ্রহণযোগ্য স্কোর। বাংলাদেশের গত ১৪ বছরের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৭ অর্থবছরে যেখানে ৭টি স্কোর ছিল লাল রঙের, সেখানে ২০২১ অর্থবছরে লাল রঙের স্কোরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১। প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের স্কোর ২০২০ সালে থেকেই প্রথম লাল রং ধারণ করে।

ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে ১৬৭টি দেশের জন্য ‘ডেমোক্রেসি ইনডেক্স’ বা গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করে আসছে। নির্বাচনপদ্ধতি ও বহুত্ববাদ, সিভিল লিবার্টিজ বা নাগরিক স্বাধীনতা, সরকার পরিচালনা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি—এই পাঁচ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গণতন্ত্র সূচক তৈরি করা হয়, যার পরিধি ১ থেকে ১০। এই গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২০০৬ সালে ছিল ৬ দশমিক ১১। ২০২০ সালে তা ৫ দশমিক ৯৯-তে নেমে এসেছে। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্সের অভিমতে, বাংলাদেশ একটি হাইব্রিডি রিজিম বা সংকর গণতন্ত্র, যেখানে গণতন্ত্রের সব অনুষ্ঠান-আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু এগুলো বহুলাংশে অকার্যকর।

জার্মানির থিঙ্ক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান বার্টেলসমান স্টিফটুং গভর্ন্যান্স ও ডেমোক্রেসি সূচক তৈরি করে থাকে, যার পরিধিও ১ থেকে ১০। তাদের গভর্ন্যান্স সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্কোর ২০১০ সালে ৪ দশমিক ৯। ২০২০ সালে তা ৪ দশমিক ৫-এ নেমে এসেছে। আর ডেমোক্রেসি সূচক ২০১০ সালে ছিল ৬ দশমিক ১। ২০২০ সালে ৪ দশমিক ৪-এ অবনতি ঘটেছে। সংস্থাটি বাংলাদেশকে ‘মডারেট অটোক্র্যাসি’ বা আংশিক কর্তৃত্ববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ ২৮টি দিক বিবেচনায় প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের সূচক তৈরি করে। এই সূচকের ভিত্তিতে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে দুর্বল গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়। এর পর থেকে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত পায়। প্রসঙ্গত, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ দুরবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ‘ডেমোক্রেসি সামিটে’ বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোর মাধ্যমে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হাল ছেড়ে দিয়েছে বলেই মনে হয়।

গভর্ন্যান্স বা সুশাসন সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের সূচকই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বাক্স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, সরকারের সক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মান, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ৪০টি উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক অবস্থানের নির্ণায়ক হিসেবে এ সূচক প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বব্যাংকের সূচক অনুযায়ী, বাক্স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবনতি সর্বাধিক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৫০ থেকে ২৬ দশমিক ৫৭-তে নেমে এসেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অভাব বা সন্ত্রাসের দিক থেকেও বাংলাদেশের বড় অবনমন ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে গত ২৪ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ২৬ দশমিক ৬০ থেকে ১৬ দশমিক শূন্য ৪-এ অবনতি ঘটেছে। সরকারের সক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামের মান এবং দুর্নীতি দূরীকরণের স্কোরের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে, যদিও এ অবনমনের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত সামান্য।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘করাপশন পারসেপশন ইন্ডেক্স’ অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ২০১৪ সালে ছিল ২৫। ২০২০ সালে তা ২৬-এ উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৫ থেকে ১৪৬-এ পরিণত হয়েছে। তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচক বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার যথার্থ প্রতিফলন নয় বলেই অনেকের আশঙ্কা। উদাহরণস্বরূপ, গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ সালের হিসাব বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। যদিও ২০১৫ সালের পর থেকে জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কোনো তথ্য নেই।

আর দুর্নীতির বিস্তৃতি কত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তার আলামত পাওয়া যায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘটনাবলি থেকে। যেহেতু দুর্নীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে লাভবান হওয়া বা অন্যকে লাভবান করাই দুর্নীতি, তাই গত জাতীয় নির্বাচনে যাঁরাই ভোটের অনিয়মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁরাই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৭৩-৭৪ ধারা অনুযায়ী ‘দুর্নীতিমূলক কার্যক্রম’ ও ‘বেআইনি কার্যক্রমে’র অপরাধ করেছেন, যার দণ্ড দুই থেকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। দুর্নীতির এ ব্যাপকতা কল্পনাকেও হার মানায় এবং একটি দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হয়!

ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টও আইনের শাসন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। তাদের আইনের শাসনের সূচক আটটি বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি, যেগুলো হলো সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, সরকারের উন্মুক্ততা, মৌলিক অধিকার, শান্তি ও শৃঙ্খলা, সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োগ, দেওয়ানি বিচার এবং ফৌজদারি বিচার, যার সর্বোচ্চ স্কোর ১। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের আইনের শাসনের সূচক ২০১৫ থেকে ২০২১ সালে শূন্য দশমিক ৪২ থেকে শূন্য দশমিক ৪০-এ অবনতি ঘটেছে। আর আইনের শাসনের দিক থেকে ১২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছর থেকে দুই ধাপ পিছিয়ে ২০২০ সালে ১১৫-এ পৌঁছেছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দিক থেকেও বাংলাদেশের অবনতি ক্রমবর্ধমান। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের তথ্যানুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২০১৫ সালের ১৪৬ থেকে ২০২১ সালে ১৫২-এ পৌঁছেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের প্রয়োগ ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রণের কারণে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস যে ৩৭টি দেশকে ‘প্রেস ফ্রিডম প্রিডেটরস’ বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাতে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত।

গুম, খুন, অপহরণ এবং নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার এক অপসংস্কৃতিও আমাদের দেশে বিরাজমান। উদাহরণস্বরূপ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালে ২২৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হলেও ২০১৮ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪৬৬ জনে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ২০৪, যদিও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় এ সময় আরও ৭৫ জন কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রসঙ্গত, গত বছর পুলিশ কর্তৃক অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার খুনের পর সারা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারবহির্ভূত হত্যায় অনেকটা লাগাম টানা হয়েছে, যদিও অনিচ্ছাকৃতভাবে নিখোঁজ হওয়া এখনো অব্যাহত। তবে হতাশার কথা যে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা ২০০৯ সালের ৪৪৬ থেকে ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭–এ উন্নীত হয়েছে।

গণতন্ত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত উল্লিখিত এসব তথ্য-উপাত্ত ও সূচক নিঃসন্দেহে কার্যকর গণতন্ত্র, তথা সুশাসন অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির পরিচায়ক নয়, বরং এ ক্ষেত্রে আমাদের যে ক্রম–অবনতি ঘটছে, তারই প্রতিফলন। এটি সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারগুলো ক্রমাগতভাবে সংকুচিত হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও বর্তমানে ভয়াবহভাবে ভূলুণ্ঠিত। আইনের শাসনের পরিবর্তে অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার এক অপসংস্কৃতি আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে। আমাদের সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলো আজ সর্বতোভাবে বিপন্ন। তাই গণতন্ত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এগুলো বহুলাংশে অধরাই থেকে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই—যারা ক্ষমতায় আছে কিংবা ক্ষমতায় ছিল—কমবেশি দায়ী। তাই জাতি হিসেবে আমাদের আজ জেগে ওঠার সময় এসেছে, তা না হলে এর মাশুল ভবিষ্যতে আমাদের সবাইকেই গুনতে হবে।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক