৩৫ বছরে আয় হবে ৯০ হাজার কোটি টাকা
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস অনুসারে, যানবাহন চলাচল করলে পদ্মা সেতু থেকে প্রথম বছর আয় হবে ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৩৫ বছরে এই সেতু থেকে আয় হবে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে এই টাকার সবই সেতুর নির্মাণ ও পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ঘরে যাবে না। প্রথমেই আয় থেকে সরকারকে ভ্যাট দিতে হবে। টোল আদায়কারীর পেছনে খরচ আছে। এরপর যা থাকবে, তা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিশোধ করতে হবে ঋণের কিস্তি। এসব ব্যয়ের পর টাকা থাকলে তা সেতু কর্তৃপক্ষের মুনাফা হিসেবে বিবেচিত হবে।
এই হচ্ছে পদ্মা সেতুর আয়-ব্যয় পরিকল্পনার সংক্ষিপ্তসার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় সেতুটি দিয়ে যানবাহন চলাচলের পূর্বাভাস তৈরি করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। পরে ২০১০ সালে নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ৩৫ বছরের যানবাহনের সংখ্যা এবং আয়ের একটা ছক তৈরি করে। এর ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালের আগস্টে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে আয়, ব্যয় ও মুনাফার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এই টাকা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ৩৫ বছরে ঋণের টাকা ১ শতাংশ হারে সুদসহ ফেরত দিতে হবে। এ জন্য তিন মাস পরপর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে ১৪০ কিস্তিতে ঋণের টাকা (সুদ ও আসলে) পরিশোধ করা হবে।
সেতু চালুর পরের কয়েক বছর মুনাফা হবে না। ২০২৯ সালে গিয়ে কিস্তি পরিশোধের পর মুনাফা করতে থাকবে সেতু বিভাগ। ২০৫০ সাল নাগাদ পদ্মা সেতু থেকে মুনাফা হবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।
যান চলাচলের পূর্বাভাস
২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত—এক বছরে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে ফেরি ঘাট দিয়ে যানবাহন চলাচলের একটি হিসাব তৈরি করেছে সেতু বিভাগ। এই চিত্র ধরেই পদ্মা সেতু থেকে আয়ের একটা প্রাথমিক ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফেরিতে যানবাহন পারাপার হয়েছে সাড়ে আট লাখ। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে ২ হাজার ৩৩০টি।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ফেরিতে দুই ঘণ্টার মতো সময় ব্যয়সহ ঘাটে যানজটে আটকে থাকার ভয়ে অনেক পরিবহন কোম্পানি ফেরি দিয়ে বাস পারাপার করে না। তারা দুই পাড়ে বাস রেখে যাত্রীদের লঞ্চে পারাপার করায়। সেতু চালু হলে যানবাহন চলাচল বেড়ে যাবে। নতুন নতুন বাস রুট চালু হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও বাড়বে। মালবাহী যানবাহন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি পথে ভোগান্তি এড়াতে পদ্মা সেতু ব্যবহার করবে।
সব মিলিয়ে যে পূর্বাভাস করা হয়েছে, তাতে চলতি বছর প্রতিদিন পদ্মা সেতু দিয়ে ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৯ সালে তা হবে ৩৪ হাজার ৭২৫। ২০৫০ সালে এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে ৬৬ হাজার ৮২৯টি।
যেভাবে খরচ হবে টোলের টাকা
এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ ফান্ডের অর্থ ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ফলে সেতু বিভাগকে আসল হিসেবে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ফেরত দিতে হবে। এর সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হবে। অর্থাৎ সুদ-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিতে টোলের টাকা ব্যয়ের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সেতুর সাধারণ রক্ষণাবেক্ষণে টোল আয়ের সাড়ে ৭ শতাংশ ব্যয় হবে। এর মধ্যে টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের খরচও আছে। প্রতি ১০ বছর পরপর বড় ধরনের মেরামত করতে হতে পারে।
এ ক্ষেত্রে চালুর দশম বছরে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। ২০তম বছরে ব্যয় করতে হবে এক হাজার কোটি টাকা। ৩০তম ও ৪০তম বছরে ব্যয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকা করে। আদায় করা টোলের ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কাটা যাবে। অবচয় হবে মোট নির্মাণব্যয়ের ২ শতাংশ হারে। সব ব্যয় শেষে যে টাকা থাকবে, তা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। আর কিস্তি পরিশোধের পর যে টাকা (মুনাফা) থাকবে, তার ওপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেবে সেতু বিভাগ।
প্রতি ১৫ বছর পরপর টোল হার ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সে হিসাবে ২০৫৩ সাল নাগাদ একটি প্রাইভেট কারের টোল ২ হাজার টাকার বেশি হবে।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, সেতু বিভাগ ঋণের টাকা তিন মাস পরপর মোট ১৪০টি কিস্তিতে পরিশোধ করবে। চালুর পর প্রথম বছর কিস্তি আসে ৫৯৬ কোটি টাকা। দশম বছরে গিয়ে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ১৬তম বছরে গিয়ে কিস্তির পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ৩৫তম বছরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, প্রথম বছরই সরকারকে ৬০০ কোটি টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। টোল থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা। আয় থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। টোল আদায়ের জন্য যে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের পেছনে ব্যয় করতে হবে। ফলে শুরুতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হবে। ১৫ বছর পর যানবাহনের চলাচল বেড়ে গেলে এবং টোলের হার বাড়ানো হলে আয় করতে শুরু করবে সেতু বিভাগ।