৩০-৩৫ জন যাত্রী নিয়ে কীভাবে যাতায়াত করে স্পিডবোট
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে চলছে লকডাউন, সঙ্গে কালবৈশাখীর আশঙ্কা। এরই মধ্যে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ যাত্রী নিয়ে চলছে স্পিডবোট। এমনকি যাত্রীদের লাইফজ্যাকেটও দেওয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার মাদারীপুরের শিবচরে কাঠাঁলবাড়ি পুরাতন ঘাটে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছেন।
ঘাট কর্তৃপক্ষ, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ সূত্র জানায়, আজ সকাল সাতটার দিকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে ৩১ জন যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজারের দিকে যাচ্ছিল। বাংলাবাজার ফেরিঘাটের কাছাকাছি এলে নোঙর করা বালুবোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে সেটির সংঘর্ষ হয়। এতে স্পিডবোটটি সজোরে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও নৌ পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সাঁতরে তীরে উঠছেন ৫ জন। তাঁদের উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে সেখানে এক নারীর মৃত্যু হয়।
যাত্রীকল্যাণ সমিতি বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে কালবৈশাখীর ভরা মৌসুম। এরই মধ্যে ৮-১০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে লাইফজ্যাকেটবিহীন ৩০-৩৫ জন যাত্রী নিয়ে কীভাবে যাতায়াত করেন? লকডাউনের মধ্যেও এত বেশিসংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট চলাচলের জন্য ঘাট ইজারাদার, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কেউ দায় এড়াতে পারে না। তাই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মীদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগে হত্যা মামলা দায়ের হওয়া উচিত। নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ১০ লাখ এবং আহতদের পাঁচ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
সরকার নৌপথের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও এই খাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা কারণে নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মালিকের মুনাফার লোভ থেকে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী পরিবহন এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা—এই মিলে দেশের নৌযানে প্রাণহানি বাড়ছে। ২০১৮ সাল থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সোয়া তিন বছরে দেশে ৬০১টি ছোট-বড় নৌ দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় ৭৭৩ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ৯১২ জন। নিখোঁজের সংখ্যা ১ হাজার ১৬৬ জন। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তারা হিসেব তৈরি করেছেন। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৮ সালে নৌ দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হন ২৩৪ জন। আর নিখোঁজ ছিলেন ৩৮৭ জন। ২০১৯ সালে নৌ দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে দাঁড়ায় ২১৯ জনে। আহত হন ২৮২ জন এবং নিখোঁজ হন ৩৭৫ জন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে টানা ৬৬ দিন লকডাউন ছিল। গণপরিবহন চলাচলেও ছিল বিধিনিষেধ। এরপরও ওই বছর নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৩ জনে। এ বছর আহত হন ৩৪২ জন এবং নিখোঁজ ছিলেন ৩৭১ জন। চলতি বছরের গত চার মাসে নৌযান দুর্ঘটনায় ইতিমধ্যে ১১৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৫৪ জন। নিখোঁজ হন ৩৩ জন।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির সূত্র বলছে, আহত ব্যক্তিদের অনেকে পরে মারা গেছেন। নিখোঁজ লোকজনের অনেকের লাশ পাওয়া যেতে পারে। অনেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসেন। কিন্তু গণমাধ্যমে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন। নিখোঁজ ও আহতের হিসাবে কিছু এদিক-ওদিক হতে পারে।
এদিকে শিবচরের ঘটনায় মাদারীপুর স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের উপপরিচালক আজাহারুল ইসলামকে প্রধান করে ছয় সদস্যদের তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন। এ ছাড়া নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। লকডাউনে স্পিডবোট বন্ধ থাকার পরও কেন এমন দুর্ঘটনা—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্পিডবোটটি মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে বাংলাবাজার আসে। তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্পিডবোট ছাড়ে। এসব বিষয় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।