২০৩০ সালের মধ্যে আমরা নোবেল প্রাইজ পাব
জামিল স্যারকে (জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী) আমি ঠিক কবে থেকে চিনি, মনে করতে পারব না। তবে ২০১১ সালে আমার লেখা ৮টি ভ্রমণকাহিনির সংকলন প্রকাশনার উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে যখন অনুষ্ঠানে আসেন, সেদিন তাঁকে আমার সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা। এরপর আরও ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম যখন ২০১৬ সালে তাঁকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানাতে হুকুম দিল বুয়েট অ্যালামনাই। একুশে পদক প্রাপ্তির সম্মাননা অনুষ্ঠানে এটা দেখানো হয়। এরপরও তাঁকে আরও কয়েকবার আমার ক্যামেরায় নিয়েছি। কখনো তিনি ডেকে নিয়েছেন, কোনো কিছু রেকর্ড করতে, কখনো-বা অন্যরা বলেছে তাঁর কিছু ধারণ করে দিতে।
বুয়েট অ্যালামনাই একটা বড় রকমের প্রামাণ্যচিত্র আমাকে দিয়ে বানায়। আমাদের বুয়েট, আগামীর বুয়েট নামের এই প্রামাণ্যচিত্র বানানোর কাজের জন্য প্রায় এক মাস একসঙ্গে কয়েকবার আমাদের বসা হয়েছে। ২০১৬ সালে বুয়েটকাল নামে আমার যে স্মৃতিচারণামূলক বই প্রকাশ হয়, তার পেছনের ফ্লাপের জন্য তিনি লিখেও দেন। এরপর প্রথম আলো একবার ঢাকার নগরায়ণ বিষয়ে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিতে আমাকে পাঠায় তাঁর কাছে। সেখানেও তিনি অকুতোভয় অনেক কথা খোলামেলা বলেন। সবশেষে তাঁর সঙ্গে আমার মোলাকাত হয় ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি। সিলেট মহানগরীতে একটা বড় পরিসরের ডিজাইন করেছে আমাদের প্রতিষ্ঠান। সিলেটের মেয়র ঢাকায় এসেছেন এ বিষয়ে তাঁর মতামত নিতে। তিনি ঢাকার বড় বড় স্থপতিকে নিয়ে এটা দেখে মতামত দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন। এই শেষ। আর দেখা হলো না।
২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত কাছাকাছি থেকে তাঁকে যেমন দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে তা হলো:
● প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী।
● ছোটবেলা খেলোয়াড় ছিলেন।
● ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী ছিলেন এবং শেষ বয়সেও প্রতিদিন কিছু না কিছু অকারিগরিবিষয়ক লেখা পড়তেন।
● আগাগোড়া মেধাবী।
● শুধু কারিগরি বিষয়ই নয়, সমসাময়িক যেকোনো বিষয়েই তিনি অগাধ জ্ঞান রাখতেন।
● কোনো বিষয়ে বা কারও সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আগে তিনি অনেক হোমওয়ার্ক করে যান।
● তাঁর বন্ধু কেমন আছে জানি না, তবে তাঁর কোনো নিন্দুক আমি খুঁজে পাইনি।
● তাঁর ব্যক্তিগত সততা কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুনিনি।
তাঁর অনেকগুলো কথা আমার কাছে রেকর্ড করা আছে। তাঁর নানা সাক্ষাত্কারে (বেশিরভাগ ২০১৮ সালে নগরায়ণ বিষয়ে প্রথম আলোর হয়ে নেওয়া) যেসব কথা বলেছিলেন, এই কথাগুলো থেকে আমাদের শেখারও অনেক কিছু আছে। নানা বিষয়ে কী ছিল চিন্তা, কী ভাবতেন, তার কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম।
রাজউক
রাজউক কিন্তু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এখন মন্ত্রী যদি নির্দেশ দেন এটা করেন, তারা করে ফেলে। তাদের হয়তো দ্বিমত ব্যক্ত করার সুযোগ আছে, ক্ষমতা আছে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তারা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই চলেন।
একটা ভবন নির্মানের আবেদনের পর থেকে ইউটিলিটি কানেশনের আগে পর্যন্ত ৪ স্তরে পর্যবেক্ষণ করে রাজউকের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা। ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ঘটনার পর রাজউক একটা তালিকা দিয়েছিল যে তখন পর্যন্ত তারা ঢাকায় মাত্র ১৮টি বিল্ডিংয়ের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দিয়েছিল। অর্থাৎ আইন বা বিধি আছে, কিন্তু মানা হয় না। বর্তমানের ইমরাত নির্মাণ বিধিমালায়ও নিয়ন্ত্রণের অনেক কথা লেখা আছে কিন্তু এগুলো কেউ দেখেটেখে না। রাজউকে এখন যে জনবল আছে, তাতে ঢাকা মহানগরের যে এত বিল্ডিং হচ্ছে, এগুলো প্রত্যেকটা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের নেই।
জনবলের অভাব একটা অজুহাত, এটা দেখিয়ে তারা কিছুই করে না। রাজউক যেহেতু এটা করতে পারবে না, প্রায় চার বছর আগে আমরা রাজউকের নিয়োগ করা একটি কমিটি থেকে আরেকটা সুপারিশ করেছিলাম যে রাজউক এটা আউটসোর্সিং করবে। বাইরের কোয়ালিফাইড কনসালটিং ফার্ম দিয়ে এই কাজ করাবে এবং কনসালট্যান্টরা রাজউক থেকে এর জন্য ফি পাবে, যে ফি রাজউকই আবেদনকারীর কাছ থেকে অনুমোদনের সময় আদায় করবে। একবারেই সব হবে না। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে অনেক উন্নতি হবে।
ভূমিদস্যু
২০১১ সালে একবার প্রতিমন্ত্রী ল্যান্ড ডেভেলপারদের বলেছিলেন যে, ‘আপনারা ভূমি দস্যুরা রাতে ঘুমান কীভাবে?’ তার কিছু দিন পরে দেখি তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। আমরা বলেছিলাম, বেআইনিভাবে যেগুলোতে মাটি ভরাট করা হয়েছে কোনো দালান বানানো হয়নি, সেগুলোতে মাটিটা সরিয়ে ফেললেই হয়। পেশায় আইনজীবী মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘আমাদের আইনে একটা কথা আছে যে একটা অবৈধ শিশু যদি জন্মগ্রহণ করে, তার বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে হবে।’ তারপরে তো আর এই ড্যাপের বাস্তবায়ন হলো না। ল্যান্ড ডেভেলপারস আর এক্সট্রিমলি পাওয়ারফুল। তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বললে জীবনের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে।
যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই যে নীতিমালা বাস্তবায়নের, তাদের অক্ষমতা। আরেকটা হলো যে টাকাপয়সা বা ক্ষমতার বিনিময়ে যেকোনো কিছুর অনুমোদন আনা যায়।
যদি এমন সরকার পাই যারা সত্যিকার অর্থে এগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তখন হবে।
বিধিমালা
নতুন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, যেটা সম্প্রতি চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি নামে একটি নতুন সংস্থার গঠন ও দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ আছে, যে সংস্থার গঠনের কথা মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল সরকারকে, যার একমাত্র দায়িত্ব হবে সারা দেশে এই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়ন করা। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থাও দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে, এই অভিযোগ সরকার থেকেই আসছে।
বুয়েটের জন্য ফান্ড
আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি যে একটা এনডোমেন্ট ফান্ড তৈরি করব, যেটার লক্ষ্যমাত্রা আপাতত ১০০ কোটি টাকা । এই টাকা কীভাবে খরচ করা হবে তা আমরা বুয়েট কর্তৃপক্ষ আর বুয়েট অ্যালামনাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করব।
তারুণ্য
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তরুণ প্রজন্ম । এদের মধ্যে যে সৃজনশীলতা দেখতে পাই, তা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে এরাই আমাদের মূল চালিকা শক্তি হবে।
স্বপ্ন
আমি এটা চ্যালেঞ্জ মনে করি, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশি একজন বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পাবেন।
শাকুর মজিদ: স্থপতি, লেখক ও চিত্রনির্মাতা