১৮–এর নিচে শিশুর বয়স আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী
দেশের শিশু আইন অনুসারে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হয়। সাভারে শিক্ষককে হত্যা, কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তারের ঘটনা উল্লেখ করে গতকাল রোববার সরকারের আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি শিশুর সর্বোচ্চ বয়স ১৮ বছর থেকে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছে। তবে শিশুর জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ ও মানবিক বোধসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত না করে এবং শিশুদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িত করার পেছনের ব্যক্তিদের শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় না এনে শুধু বয়স কমিয়ে শিশুদের অপরাধে শামিল হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না মন্তব্য করেছেন আইনজীবী, শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি এবং শিশু-কিশোর মনোচিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, বয়স সংশোধন করতে হলে শিশুনীতি, আন্তর্জাতিক সনদ থেকে শুরু করে বহু জায়গায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হবে।
শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান একটি ভ্রান্ত ধারণা: শাহদীন মালিক
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকের মতে, শিশুর বয়স কমানোর সিদ্ধান্ত হবে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু বিবেচনা করা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রথমত, বয়স পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হবে। আর দ্বিতীয়ত, দেশে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে শাস্তি দিয়ে সামাজিক সমস্যার সমাধান করা যায়। এ কারণে সমাজটা শাস্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হয় এই কারণে যে এর কম বয়সীদের মধ্যে অপরাধমূলক কাজ কেন করছে ও কেন শাস্তি পাচ্ছে, তা বোঝার মতো সক্ষমতা নেই। এর পরিণতি যে ভালো হবে না, সেটা তারা বোঝে না। তাই বয়স কমানোর চেয়ে শিশুকে যথাযথভাবে গড়ে তুলতে শিশুর জন্য শিক্ষণীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পরিবারে, সমাজে ও রাজনীতিতে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, পরমত সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা চালু করতে হবে। শিশুরা যা দেখে বড় হয়, তা–ই শেখে।
হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না: ওয়াহিদা বানু
শিশু অধিকার রক্ষাবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রস্তাব নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা ও বিতর্ক আয়োজনের প্রয়োজন আছে। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাবে না। শিশু–সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সব সনদে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর বিষয়টিতে সরকার সমর্থন দিয়ে স্বাক্ষর করেছে। সেই দিকও বিবেচনায় রাখতে হবে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে তা হবে ওই সব নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সরকার শিশু আইন ২০১৩ সংশোধনের উদ্যোগ নেয় ২০১৮ সালে। সেটা চূড়ান্ত হয়নি। অধিকারকর্মীরা জানেন না সংশোধনী কী অবস্থায় আছে। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে শুধু শিশু–কিশোরদের দোষারোপ করে লাভ নেই। হোতা কারা, সেটা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিন। তিনি আরও বলেন, আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশুদের ঠিক কোন বিষয়কে লক্ষ্য করে, কোন অপরাধে কী ধরনের শাস্তির কথা ভেবে বয়সে পরিবর্তন আনার কথা ভাবা হচ্ছে, সেটাও স্পষ্ট করতে হবে।
শুধু বয়স কমিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না: ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
আইনের সংঘাতে আসা শিশুদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা সংশোধনী পরিকল্পনা করার ওপর জোর দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বিজ্ঞানের ভাষায়, একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের গঠন সম্পন্ন হয় ১৮ বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ প্রতিটি দেশকে নিজেদের সামাজিক–সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে শিশুর বয়স ১৮ বছর বিষয়টিতে স্বাক্ষর করার কথা বলেছে। যারা এটা মানতে পারবে না, তারা স্বাক্ষর করেনি। অনেক দেশ শিশুর বয়স ১২, ১৫, ১৬ বছর রেখে নিজস্ব আইন পরিচালনা করছে। বাংলাদেশকে শিশুর বয়স কমিয়ে আনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার আগে বিবেচনায় রাখতে হবে যে এ দেশ শিশু সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। বয়স কমিয়ে আনার উদ্দেশ্য সুফল নাকি কুফল বয়ে আনবে, সেটি বিশ্লেষণ করতে হবে। তথ্য–প্রমাণ দেখাতে হবে যে ১৮ বছরের নিচের বয়সীদের অপরাধ করার হার কত, এর মধ্যে কোন বয়সীরা কোন ধরনের অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের পরিচালক কারা, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সারা বিশ্বে এখন সংশোধন কেন্দ্রের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। যে শিশুরা অপরাধে জড়িত হচ্ছে, তাদের সংশোধনের জায়গাটি আরও শক্তিশালী করতে হবে। তাই শুধু বয়স কমিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
মন্ত্রী যা বললেন
আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত কমিটির সভার প্রস্তাবটি সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনার জন্য আইনমন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে বলেছে কমিটি। কারণ, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা অবাস্তব। কিছুদিন আগে শিক্ষককে এক ছাত্র হত্যা করেছে। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। শিশু বিবেচনায় নিয়ে তাদের শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না।
শিশুর বয়স কমাতে হলে কত বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৪ বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। ১৪ থেকে ১৮ কিশোর বিবেচনা করে শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে অপরাধ কমবে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, কিছু তো কমবেই। ফাঁসির ব্যবস্থা আছে বলে তো হত্যা বন্ধ হয়নি, কিন্তু অপরাধ করলে শাস্তির ভয় তো আছে। তেমনি শিশুদের ক্ষেত্রেও অপরাধ নির্মূল করা হয়তো যাবে না। কিন্তু সাজার ভয় অপরাধ থেকে বিরত থাকার হার বাড়াবে।
বয়স কমালে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হবে কি না, জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, পরিপন্থী হবে, অনেক আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। সেসব বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।