ঢাকা শহরে এ বছর প্রতি ১০ জনে ১ জনের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর প্রাদুর্ভাব চলবে। সব মিলিয়ে এবার শহরের কমপক্ষে ১৮ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
২০১১ সাল থেকে চিকুনগুনিয়া নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) করা তিনটি জরিপের ওপর ভিত্তি করে এই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আইইডিসিআর জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মুঠোফোনে একটি জরিপ করেছিল। ৪ হাজার ৭৭৫ জনের তথ্য তারা সংগ্রহ করেছিল। তাদের মধ্যে ৩৫৭ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। এই হিসাবে আক্রান্তের হার সাড়ে ৭ শতাংশ। এই সংখ্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় উল্লেখ করেছিল আইইডিসিআর। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখনো এ ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। এই জরিপ অনুযায়ী, জনসংখ্যার হিসাবে ইতিমধ্যে আক্রান্তর সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৭ হাজার।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালে ঢাকার দোহার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে চিকুনগুনিয়া নিয়ে দুটি এবং ২০১৩ সালে ঢাকা শহরের চারটি থানায় ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে একটি জরিপ করা হয়। এসব জরিপের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ বছর ঢাকা শহরের লোকসংখ্যার ১০ শতাংশ পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের জনসংখ্যা বিভাগ বলছে, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ১ কোটি ৮২ লাখ ৩৭ হাজার। ওই সংখ্যার ভিত্তিতে বলা যায়, ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ঢাকা শহরে ১৮ লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তবে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে ১০ জনে ১ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে—এই তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না।’ এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
ঢাকা শহরে এবার চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুরু হয়েছে গত ডিসেম্বর থেকে। এ বছরের এপ্রিল-মে থেকে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের শীর্ষ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতিকে মহামারি বলেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তা নিয়ে পরিষ্কার তথ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে না। আনুমানিক সংখ্যা জানার কার্যকর কোনো উদ্যোগের কথাও জানা যায়নি।
২০১২ সালে টাঙ্গাইলের পালপাড়ায় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন আইসিডিডিআরবি ও আইইডিসিআর যৌথভাবে একটি জরিপ চালায়। তাতে ৪৬০টি পরিবারের ১ হাজার ৯৩৩ জনের মধ্যে ৩৬৪ জনকে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এখানে আক্রান্তের হার প্রায় ১৮ শতাংশ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি পরিবারে চিকুনগুনিয়ার রোগী। কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্যই আক্রান্ত। ১০ শতাংশ মানুষ যে আক্রান্ত হবে, এটা কোনো ঝুঁকি ছাড়াই বলা যায়। কারণ, কোনো জরিপেই আক্রান্তের হার ১৫ শতাংশের নিচে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা শহরে বস্তির মানুষের মধ্যে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ কম। এমন পর্যবেক্ষণ স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক এক মহাপরিচালকের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বস্তির আশপাশে পরিষ্কার পানি জমে থাকার সুযোগ কম। তাই বস্তিতে এডিস মশার প্রকোপ কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপেও দেখা গেছে, বস্তিতে এডিস মশা কম। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, বস্তিতে প্রকোপ বেশি হলে আক্রান্তের হার বেড়ে যেত। কারণ, ঢাকার মানুষের প্রায় ৩০ শতাংশ বস্তিতে বাস করে।
তিন জরিপ
আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২০১১ সালে দোহারে ও শিবগঞ্জে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। রোগটি কত মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে, তা দেখার জন্য অনুসন্ধান করে সংস্থাটি। সে সময় দোহারের ৬৪০ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেছিল আইইডিসিআর। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ নমুনায় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়।
আর শিবগঞ্জে ৬ হাজার ২৬০ জনের ওপর জরিপ করে সংস্থাটি। তাতে ২০ শতাংশের চিকুনগুনিয়া হয়েছিল বলে জানা যায়।
২০১৩ সালে রাজধানীর সূত্রাপুর, ধানমন্ডি, মতিঝিল ও আদাবর থানায় ডেঙ্গু নিয়ে জরিপ করে আইইডিসিআর। প্রতি ৯টি বাড়ির পর ১০ নম্বর বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাতে ৩৩ শতাংশ মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ পাওয়া যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ পাওয়া গেছে। তবে একাধিকবার চাইলেও এসব জরিপের বিস্তারিত তথ্য আইইডিসিআরের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
এসব অনুসন্ধানের সময় আইইডিসিআরের পরিচালক ছিলেন মাহমুদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের প্রাদুর্ভাব ছিল ছোট আকারের। আগের তথ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে রক্ষণশীল হিসাবে আমার মনে হয়, এই মৌসুমে ঢাকা শহরের ১০ ভাগ লোকের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’