১১১ বছরে এসে থমকে গেল ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখেলা

ছবি: সৌরভ দাশ
ছবি: সৌরভ দাশ

করোনার এই থাবা দেশের অনেক আনন্দ–উৎসবকে থামিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখেলা। করোনার কারণে হচ্ছে না এবারের জব্বারের বলীখেলা।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি ‘বলীখেলা’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতি ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলীখেলা। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু আফসোস, এবার সেই বলীখেলা দেখা হবে না।


জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘি ময়দানের আশপাশে প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বড় বৈশাখী মেলা।

ছবি: সৌরভ দাশ
ছবি: সৌরভ দাশ

বাংলা-বিহার-ওডিশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এ দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। একসময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। শুরু হয় স্বদেশি আন্দোলন। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর প্রেরণা থেকেই চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলীখেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ লালদীঘি ময়দানে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।

চট্টগ্রামের মুরব্বিদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের ১৯টি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী, সাহসী পুরুষ এবং তাঁদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরত প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলীখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।

যদিও অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চেনে। কিন্তু বৈশাখী মেলা হোক আর বলীখেলা হোক—কিছুই যে এবার হচ্ছে না, সেটা নিশ্চিত।

জব্বার মিয়ার বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘি ময়দানের আশপাশের এলাকা ঘিরে। জব্বারের বলীখেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলীখেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলীখেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলীখেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলীখেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলীখেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলীখেলা এখনো কোনো রকমে বিদ্যমান। যদিও এবার কোনোখানেই এই খেলা অনুষ্ঠিত হবে না। পয়লা বৈশাখ ঘিরে যে আয়োজন হয়, ইতিমধ্যে আমরা সেই আয়োজন থেকেও বঞ্চিত হয়েছি করোনার জন্য।

জব্বরের বলীখেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলী। জব্বারের বলীখেলায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন দিদার বলী। তিনি সর্বোচ্চ ১৩ বার বিজয়ী হয়েছেন। বর্তমানে দিদার বলী এ খেলা থেকে অবসরে আছেন।

বলীখেলা যাঁরা নিয়মিত দেখতে আসেন, তাঁদের কাছে এবারের বলীখেলা নিয়ে বেশ প্রত্যাশাও ছিল। কারণ, আয়োজকেরা এবারের বলীখেলা আরও সৌন্দর্য ও চমকপ্রদ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। সেই কথাটা রাখার সুযোগ দিল না করোনা।

আশা করি, ঐতিহাসিক এ খেলাটি ১১২ বছরে পদার্পণ করবে আরও জাঁকজমকপূর্ণভাবে। সেদিন এই বলীখেলা দেখব সবাই পাশে থেকে। পৃথিবী তার আগেই সুস্থ হয়ে উঠবে, সেই কামনা করি।


*লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়