১১ জেলায় ১৯ জন নিহত
একতরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন গতকাল রোববার ১৯ জন নিহত হয়েছে। এঁদের প্রায় সবাই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী। এঁদের মধ্যে ১৫ জনই পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। দেশে ভোটের দিন এত প্রাণহানি এর আগে ঘটেনি।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন: ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় কর্মী হারুন (৪০), জয়নাল (২৮) ও আবু হানিফ (২৮), রংপুরের পীরগাছায় মেরাজুল ইসলাম (৩৫) ও হাদিউজ্জামান (১৭), নওগাঁর মান্দা উপজেলায় বাবুল হোসেন (২৮), নীলফামারীতে মমতাজ হোসেন (৫০) ও জাহাঙ্গীর আলম (২৫), ফেনীর সোনাগাজীতে জামশেদ আলম (২৭) ও ছাত্রদল নেতা শহীদুল্লাহ (২৫), চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় মো. এনামুল হক (৩০), গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে শাহাবুল (৩৫), যশোরের মনিরামপুরে মতিয়ার রহমান (২৮), মুন্সীগঞ্জে কনকন সৈয়াল (২৫), লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে মো. রুবেল (২৬) এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আনসার ভিডিপি সদস্য আবদুল ওয়াহেদ (৩৫), জাগপা নেতা মাসুদ রায়হান (২২), বীরগঞ্জের মাদ্রাসাছাত্র মো. সালাউদ্দিন (১৭) ও বাবুল হোসেন (৩৩)।
ঠাকুরগাঁওয়ে নিহত ৩: সদর উপজেলায় নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে বিএনপির দুই কর্মী নিহত হন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন বিএনপির আরেক কর্মী।
জানা গেছে, উপজেলার বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুপুর ১২টার দিকে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। এ সময় পুলিশের গুলিতে বিএনপির কর্মী জয়নাল ও হারুন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। বেলা তিনটার দিকে গড়েয়া গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান বিএনপির কর্মী আবু হানিফ।
রংপুরে নিহত ২: প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, রংপুরের পীরগাছায় শনিবার রাত তিনটার দিকে পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের দেউতি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালান জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এ সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ গুলি চালালে মেরাজুল ইসলাম ও হাদিউজ্জামান নামের জামায়াত-শিবিরের দুই কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
পীরগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মকবুল হোসেন দুজন নিহত হওয়ার ঘটনা নিশ্চিত করে জানান, নির্বাচনী মালামাল নিয়ে যাওয়ার সময় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বাধা দেন। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে।
এদিকে পীরগাছার ৯০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫১টি কেন্দ্রের নির্বাচনী সরঞ্জাম ভোরের দিকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ সময় বিএনপির কর্মীরা বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে ছয়জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ ছাত্রদল ও যুবদলের সাত কর্মী আহত হন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহিদুল ইমলাম জানান, এ ঘটনার পর ওই ৫১টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
নীলফামারীতে নিহত ২: নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের ব্যাপারীতলা আলীম মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে শনিবার রাত দুইটার দিকে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে শিবিরকর্মী জাহাঙ্গীর আলম নিহত হন। তিনি কারমাইকেল কলেজের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
জলঢাকা উপজেলার বালাপাড়া গাবরোল কাছারী বালিকা বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সকাল ১০টার দিকে হামলা চালায় জামায়াত-শিবির। এ সময় পুলিশের গুলিতে মমতাজ হোসেন (৫০) ও আবেদুল ইসলাম (৩০) নামের জামায়াত-শিবিরের দুই কর্মী আহত হন। বাড়িতে নেওয়ার পর মমতাজের মৃত্যু হয়। তিনি ভেরভেরী দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক।
ফেনীতে নিহত ২: ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চরচান্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে বেলা ১১টার দিকে হামলা চালান যুবদল-ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশের গুলিতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের সোনাগাজী হাসপাতালে নেওয়ার পথে জামশেদ আলমের মৃত্যু হয়। সোনাগাজী হাসপাতাল থেকে সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান শহীদুল্লাহ। জামশেদ আলম সোনাগাজীর চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া ওয়ার্ড যুবদলের সহসভাপতি এবং শহীদুল্লাহ ছিলেন একই ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) পরিতোষ ঘোষ দুজন নিহত ঘটনা নিশ্চিত করেন।
দিনাজপুরে নিহত ২: দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ৮৭টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ২২টি কেন্দ্রে নির্বাচনবিরোধীরা হামলা চালায়। উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নের উত্তর শালন্দার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সকাল আটটার দিকে ৪০০-৫০০ ব্যক্তি হামলা চালিয়ে কেন্দ্রের নির্বাচনী কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যাপক মারধর করে। এ সময় প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে আনসার ভিডিপি সদস্য আবদুল ওয়াহেদ পালাতে গিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছোট যমুনা নদীর তীরে পড়ে প্রাণ হারান।
বেলা সাড়ে ১১টার বিক্ষুব্ধ জনতা মোমিনপুর ইউনিয়নের যশাই উচ্চবিদ্যালয়ে হামলা চালায়। এতে নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ ছয়জন আহত হন। হামলাকারীরা ছয়টি ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার পুড়িয়ে দেয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় একই ইউনিয়নের মন্মথপুর কো-অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে হামলা চালায় নির্বাচনবিরোধীরা। এ সময় পুলিশের গুলিতে উপজেলা জাগপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রায়হান নিহত হন। এ ছাড়া বাবুল হোসেন ভোটকেন্দ্রে হামলা চালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ছাড়া বীরগঞ্জের মাদ্রাসাছাত্র মো. সালাউদ্দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পিটুনিতে আহত হয়। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
নওগাঁয় নিহত ১: নওগাঁর মান্দা উপজেলার চকদেবীরাম গ্রামে ভোট দানে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে বিএনপি কর্মী বাবুল হোসেনসহ সাতজন গুলিবিদ্ধ হন। আহত ব্যক্তিদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে বাবুলের মৃত্যু হয়।
মান্দা থানার ওসি আবদুল্লাহেল বাকি জানান, সকাল থেকেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা তির-ধনুক, লাঠিসোঁটা নিয়ে সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়ে আসছিলেন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে পুলিশ গুলি চালায়।
তবে মান্দা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মকলেছুর রহমান বলেন, তাঁদের নেতা-কর্মীরা কাউকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেননি।
চট্টগ্রামে নিহত ১: চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের ১৪৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫টি কেন্দ্রে সহিংসতা হয়। এসব ঘটনায় অন্তত ২৫ জন আহত হন। লোহাগাড়ায় পুলিশের গুলিতে মো. এনামুল হক নামে শিবিরের এক কর্মী নিহত হন।
লোহাগাড়া থানার ওসি মো. শাহজাহান জানান, ভোট গ্রহণ শেষে উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার উপজেলা সদরে আনার পথে সন্ধ্যা পাঁচটার দিকে হামলা চালান শিবিরের কর্মীরা। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে শিবিরের এক কর্মী মারা যান।
সাতকানিয়ার ঢেমশা বড়ুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা একটার দিকে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা হামলা চালান। হামলাকারীরা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন এবং দুই সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অনিল কান্তি বড়ুয়া ও নাজিমুল ইসলামকে মারধর করেন। তাঁরা কেন্দ্রের আসবাবপত্র বের করে পাশের একটি ডোবায় ফেলে দেন এবং কিছু ব্যালট পেপার নিয়ে যান। হামলায় পুলিশসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
সাতকানিয়ার ছদাহ আজিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে শনিবার রাতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এ সময় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুছকে মারধর করে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়।
গাইবান্ধায় নিহত ১: পুলিশ জানায়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মন্মথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে বেলা তিনটার দিকে হামলা চালায় জামায়াত-শিবির। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের বাধা দিতে গেলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে জামায়াতের কর্মী শাহাবুলসহ উভয় পক্ষের ১৫ জন আহত হন। শাহাবুলকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন ঘটনাটি নিশ্চিত করেন।
যশোরে নিহত ১: যশোরের মনিরামপুর উপজেলার দুর্বাডাঙা ইউনিয়নের বাজিতপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুপুর ১২টার দিকে হামলা চালান বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে যুবদলের কর্মী মতিয়ার রহমানের মাথায় গুলি লাগে। কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
লক্ষ্মীপুরে নিহত ১: লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নের মাসিমপুর উচ্চবিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র সকাল থেকে ঘিরে রাখেন বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। বেলা একটার দিকে তাঁরা কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে শিবিরকর্মী মো. রুবেলসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। আহত ব্যক্তিদের হাসপাতাল নেওয়ার পথে রুবেলের মৃত্যু হয়।
এ ছাড়া রামগঞ্জ সরকারি বিদ্যালয়ে পুলিশ ও শিবিবের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের গুলিতে একজন আহত হন।
মুন্সিগঞ্জে একজনের মৃত্যু: মুন্সিগঞ্জ-২ আসনের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দক্ষিণ শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে শনিবার রাতে একটি পেট্রলবোমা ছোড়েন কাঠাদিয়া শিমুলিয়া ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক কনকন সৈয়ালসহ কয়েকজন। এ সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা হামলাকারীদের ধাওয়া করলে কনকন সৈয়াল পাশের ডোবায় ঝাঁপ দেন। পরে ওই ডোবা থেকে পুলিশ তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে।
তবে টঙ্গিবাড়ী থানার ওসি মো. আবদুল মালেক বলেন, কনকনকে কেউ ধাওয়া দেয়নি। একটি লাশ পুকুরে ভাসছে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।
জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আমিনুল ইসলাম জসিম জানান, বোমা মারার ঘটনাটি সত্য নয়।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের ফেনী ও রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর অফিস, ঠাকুরগাঁও, পীরগাছা, আদমদীঘি, নীলফামারী, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, গাইবান্ধা, মুন্সিগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, পার্বতীপুর ও রায়পুর প্রতিনিধি