ইজারা নিয়ে মামলার জেরে ১০ বছর বন্ধ থাকার পর চালু হয়েছে নীলফামারীর তিস্তা বুড়ি সেচ প্রকল্প। এর আওতায় দুটি উপজেলার আটটি ইউনিয়নের আবাদি জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। প্রায় আট হাজার একর জমিতে সেচের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সুবিধাভোগী কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।
২০১১ সালের মার্চে সেচ প্রকল্পের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। এটি চালু হয়েছে চলতি বছরের ২৮ জুলাই থেকে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলতি খরা মৌসুমে এই সেচ প্রকল্পের পানি পেয়ে খুশি কৃষকেরা। সেচ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রকল্প এলাকায় গত ১০ বছরে ধানের উৎপাদন কমেছে ৬০ হাজার মেট্রিক টন। এই ধানের বাজারমূল্য প্রায় ১৩২ কোটি টাকা।
জেলার জলঢাকা উপজেলার গোলনা ইউনিয়নের কালীগঞ্জে বুড়ি তিস্তা নদীর ওপরে এই সেচ প্রকল্প। ৫৪ লাখ ১১ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয় ১৯৮৩ সালে। ওই সময় প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকা ছিল ১১ হাজার ৮৮০ হেক্টর এবং সেচযোগ্য এলাকা নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার ২৫৮ হেক্টর।
বুড়ি তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এস আর শফিক সাদিক বলেন, নতুন করে চালুর পর এই প্রকল্প এলাকার প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। এ বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সেচ দেওয়ার জন্য কৃষকদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেবে না। জেলার জলঢাকা ও ডিমলা উপজেলার আটটি ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার কৃষক সেচ সুবিধা পাচ্ছেন। এর আগে প্রয়োজনীয় পানির অভাবে এসব এলাকার অনেক জমি পতিত থাকত। তখন এসব জমিতে তামাক, ভুট্টা ছাড়া অন্য ফসলের আবাদ হতো না।
সম্প্রতি জলঢাকা উপজেলার খারিজা গোলনা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জমিতে আমন চারা লাগাতে ব্যস্ত কৃষকেরা। গ্রামের কৃষক আতাউর রহমান (৩৫) বলেন, খরার কারণে তাঁর ছয় বিঘা জমিতে আমন চারা রোপণ করতে পারছেন না। মোটর (সেচ পাম্প) দিয়ে সেচ দিলে খরচও বেশি হতো। এবার সেচ প্রকল্পের পানি পাওয়ায় উৎপাদন খরচও কমবে। সারা বছর পানি দেওয়া অব্যাহত রাখলে বোরো মৌসুমেও সহজে চাষাবাদ করা যাবে।
গোলনা মেম্বার পাড়া গ্রামের বীরেন্দ্র বর্মণ (৮০) বলেন, ‘নালার (সেচ খালের) পানি না হইলে এই এলাকাত কাও (কেউ) ওয়া (আমন চারা) গাড়ির পাইল না হয়। এত দিন পাটা (পাট) কাটি মানুষ পালা করি থুইছোলো। নালাত পানি আসি সবারে উপকার হইছে।’
পাউবো সূত্রে জানা যায়, বুড়ি তিস্তা সেচ প্রকল্পের সামনের ১ হাজার ২১৭ একর জলাধার (রিজার্ভার) মৎস্য চাহিদা মেটাতে ও রাজস্ব আয় বাড়াতে বিভিন্ন মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে তুসুকা রিসোর্সেস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালের ১৬ মে থেকে ২০২০ সালের ১৫ মে পর্যন্ত ১০ বছরের জন্য ইজারা পায়। এ অবস্থায় স্থানীয় মৎস্যজীবী-কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি দুলাল হোসেন ওই ইজারা কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত প্রথম দফায় ২০১১ সালের ৮ মার্চ ও দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ৩ আগস্ট তিন মাসের এবং তৃতীয় দফায় ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ইজারা কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এতে সেচ কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালের ১৪ মে জলাধারের ইজারা বাতিল করে পাউবো। এরপর তারা উচ্চ আদালতকে বিষয়টি অবগত করে।
২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট ওই রিট পিটিশনটি খারিজ করে দেন। এরপর সেচ প্রকল্প পুনরায় সচল করার ক্ষেত্রে আর কোনো আইনগত বাধা নেই মর্মে পাউবো থেকে জানানো হয়। এ অবস্থায় সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সেচ প্রকল্পটি পুনরায় চালু করার নির্দেশনা আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকদের সুবিধার্থে চলতি বছরের ২৮ জুলাই থেকে সেচ খালে প্রকল্পের পানি সরবরাহ শুরু হয়।
নীলফামারী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কৃষকদের চাহিদার কথা চিন্তা করে কিছু সংস্কারকাজ সেরে সেচ সুবিধা চালু করা হয়েছে। প্রকল্পের অবকাঠামো সংস্কার, নির্মাণ ও জলাধার খননের জন্য সম্প্রতি একনেকের সভায় ১২০ কোটি টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব কাজ বাস্তবায়িত হলে প্রকল্প থেকে আরও বেশি সুবিধা মিলবে বলে মনে করেন তিনি।