মামলার পাঁচ বছর পার হয়েছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ১১ মামলায় অভিযুক্ত হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদসহ অন্যদের বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মার্চ পর্যন্ত ১১ মামলার অভিযোগপত্রভূক্ত ৮৫৩ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে ২৮২ জনের। মামলার অভিযুক্ত একজন আসামি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় এবং তাঁকে আদালতে হাজির না করায় ওই সময় পর্যন্ত মামলাগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণের শুনানির তারিখ একাধিকবার পিছিয়েছে। কয়েকটি শুনানির তারিখে সাক্ষীকে আদালতে হাজির না করানোয় শুনানি পিছিয়েছে। মামলার শুনানির তারিখে কারাগার থেকে আসামিদের আদালতে হাজির না করার কারণেও একাধিকবার শুনানি পেছানোর ঘটনা ঘটেছে। আবার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন মামলার আলামত আদালতে উপস্থাপন না করার কারণেও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন নিয়মিত দুদক আদালতে সাক্ষী হাজির করছে। তবে একজন আসামি অসুস্থ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি বেশ কয়েক দিন। এখন আবার শুরু হয়েছে।’ দুদকের এই আইনজীবী বলেন, সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় হল-মার্ক কেলেঙ্কারির এই ১১টি মূল মামলার বিচার যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে ব্যাপারে দুদক তৎপর।
নথিপত্রের তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) হোটেল শাখা থেকে হল–মার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে দায় (ফান্ডেড) অর্থ হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা। এ ঘটনায় ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
তদন্ত শেষে পরের বছর ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ১১টি মামলায় হল-মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তাঁর ভায়রা তুষার আহমেদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়। পরে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৭ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। পরে এই ১১টি মামলা বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১–এ বদলি করা হয়। এখন এই আদালতে মামলাগুলোর বিচার চলছে।
অভিযুক্তরা আসামিরা হলেন হল-মার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী হল-মার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, হল-মার্কের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. জিয়াউর রহমান, কর্মকতা মো. জাহাঙ্গীর আলম, অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিংয়ের মালিক আবদুল বাসির। টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, প্যারাগন গ্রুপের পরিচালক সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক, সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার। সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান (গ্রেপ্তার হওয়ার পর মারা যান), কর্মকর্তা মো. সাইফুল হাসান, আবদুল মতিন ও মেহেরুন্নেসা মেরি, ননী গোপাল নাথ, মফিজইদ্দিন, মীর মহিদুর রহমান, হুমায়ুন কবির, মাইনুল হক, আতিকুর রহমান, শেখ আলতাফ হোসেন, মো. সফিকউদ্দিন আহমেদ ও মো. কামরুল হোসেন খান।
এর মধ্যে কারাগারে আছেন আসামি তানভীর, তাঁর স্ত্রী জেসমিন ইসলাম, তুষার আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মীর মহিদুর রহমান, শেখ আলতাফ হোসেন, সফিজ উদ্দিন, মাইনুল হক, কামরুল হাসান খান। বেশ কয়েক মাস ধরে পুলিশ পাহারায় মাইক্রোবাসে করে তানভীরসহ অন্য আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে আনতে দেখা যায়। জামিনে আছেন আসামি জামাল উদ্দিন। বাকি ১৬ জন পলাতক।
বিচারের হালচাল
হল–মার্কের এমডি তানভীরদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন এগারটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় (মামলা নম্বর ১১/২০১৬) ৮১ জনের মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এই মামলাতেই সর্বোচ্চ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
এর বাইরে ৫/১৬ নম্বর মামলায় ৭৭ জন সাক্ষীর মধ্যে তিনজন, ৭/১৬ নম্বর মামলায় ৭৫ জনের মধ্যে ছয়জন, ১৩/১৬ নম্বর মামলায় ৭৯ জনের মধ্যে ছয়জন, ১৪/২০১৬ নম্বর মামলায় ৭৯ জনের মধ্যে ছয়জন, ৯/১৬ নম্বর মামলায় ৮২ জনের মধ্যে ১০ জন, ৮/১৬ নম্বর মামলায় ৭৭ জনের মধ্যে ছয়জন, ৬/১৬ নম্বর মামলায় ৭৮ জনের মধ্যে দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ১০/১৬ নম্বর মামলায় ৭৩ জনের মধ্যে ১০ জন এবং ১২/১৬ নম্বর মামলায় ৭৯ জনের মধ্যে সাতজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
আদালত সূত্র বলছে, ৬/১৬ নম্বর মামলায় অন্তত ১১টি শুনানি পিছিয়েছে কেবল সাক্ষী হাজির না করানোর জন্য। আবার কারাগারে থাকা আসামিদের আদালতে হাজির না করার জন্য অন্তত দুবার শুনানি পিছিয়েছে। এ মামলায় শুনানির তারিখে জব্দ তালিকা হাজির না করার জন্যেও দুবার শুনানি মুলতবি হয়েছে। অন্য মামলাগুলোতেও একই কারণে শুনানির তারিখ পিছিয়েছে।
কবে নাগাদ মামলাগুলোর বিচার শেষ হবে, সে ব্যাপারে দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছর মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ হতে পারে বলে তিনি আশা করছেন। কারণ, সব সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হবে না। প্রয়োজনীয়সংখ্যক সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হবে। একটি মামলার বিচার শেষ হলে বাকিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। কারণ, মামলাগুলো প্রায় একই ধরনের।
ঠিকমতো সাক্ষী হাজির না করা এবং কারাগার থেকে কখনো কখনো আসামি হাজির না করার জন্য বিচার বিলম্বের বিষয়টি জানানোর পর সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হল-মার্ক কেলেঙ্কারির মামলাগুলোর বিচার বিলম্বের ঘটনা খুব দুঃখজনক ঘটনা। মামলার পাঁচ বছরেও কেন বিচার শেষ হলো না, এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি। সাক্ষী হাজির করানো যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা কেন সাক্ষী ঠিকমতো আদালতে হাজির করলেন না? কারও গাফিলতি থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি।