হেলমেট নেই, লাইসেন্স নেই, চলাচল ইচ্ছেমতো

জেলা-উপজেলায় মোটরসাইকেল চলাচলে আইন মানা হয় না। দুর্ঘটনার ৮৫% মহাসড়ক, আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কে।

তিন বন্ধু বায়েজিদ, জাকারিয়া ও সাকিব। তিনজনেরই বয়স ২২ বছরের আশপাশে। মেলা থেকে মোটরসাইকেলে একসঙ্গে ফিরছিলেন। পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজনই মারা যান। বাবা-মায়েরা হারান তাঁদের আদরের সন্তানদের।

ঘটনাটি ঘটে গত ৯ মার্চ বাগেরহাটের মোংলায়। পুলিশ ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবার জানায়, মোটরসাইকেলটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা দিয়েছিল। গুরুতর আহত এই তিন তরুণকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

বায়েজিদের বাবা মো. জাহাঙ্গীর (৬০) এখন দোকানের সামনে থেকে ছেলের মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটির সিসিটিভি ফুটেজ বারবার দেখেন, আর কাঁদেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বায়েজিদ তাঁর চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে। তাঁর সঙ্গে বায়েজিদ দোকানে বসতেন। তাঁকে চা বানিয়ে খাওয়াতেন। মুঠোফোনে এসব বলতে বলতে জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠে।

পরিবার ও পুলিশ জানায়, এই তিনজনের কারও মাথায় হেলমেট ছিল না। মোটরসাইকেলের চালকের ছিল না চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স। অভিযোগ রয়েছে, মোটরসাইকেলে তিনজন ওঠা নিষিদ্ধ হলেও মোংলায় অহরহ এই নিয়ম ভাঙা হয়।

আরও পড়ুন

শুধু মোংলা নয়, জেলা, উপজেলা ও গ্রামের চিত্রটি এমনই। বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূল শহরের বাইরে মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে নিয়ম মানার কোনো তাগিদ কারও মধ্যে নেই। চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরেন না, বেশির ভাগ চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না এবং এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও অহরহ চলে।

এসব নিয়ম মানাতে পুলিশেরও কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। যদিও রাজধানীতে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলা নিশ্চিতে পুলিশের কড়া তদারকি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানী ঢাকার মতো সারা দেশে যদি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ড্রাইভিং লাইসেন্স, হেলমেট ও মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়ম মানানো যেত, তাহলে ঝুঁকি কমত। দেশে মোটরসাইকেল বাড়ছে। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনাও বাড়ছে। এ অবস্থায় নিয়ম মানতে জোর দেওয়ার কোনো বিকল্পও নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ওয়েবসাইটে একটি নির্দেশিকায় বলা আছে, সঠিকভাবে হেলমেট পরিধান করলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে। আর গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ।

জেলা-উপজেলায় মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে তদারকি কেন করা হচ্ছে না জানতে চাইলে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষমতা অনুযায়ী তাঁরা সড়কে নজরদারি করেন। তবে তিনি মনে করেন, মানুষের সচেতনতার অভাব আছে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, অসচেতন মানুষকে বাধ্য করার কাজটি পুলিশের। এ জন্যই সড়ক আইন করা হয়েছে।

দুর্ঘটনা বেশি শহরের বাইরে

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে মোট ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। আর ২০২১ সালে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৩৯ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ২০২১ সালে আগের বছরের চেয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ ও এই দুর্ঘটনাগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫১ শতাংশ বেড়েছে।

একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বড় শহরের বাইরে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেশি। মোট মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ৮৫ শতাংশ হয় জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে। বাকিটা শহরে। দুর্ঘটনা বেশি ঢাকা জেলা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, নওগাঁ ও টাঙ্গাইলে। ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ৭৪ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর।

মোটরসাইকেল চালাতে ভালো মানের হেলমেটের বিকল্প নেই। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ভালো মানের হেলমেট মাথাকে অনেকটা সুরক্ষা দেয়।
শেখ নোমান রাহুল, জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক, ইয়ামাহা রাইডিং একাডেমি

‘হেলমেটটা থাকলে হয়তো বেঁচে যেত’

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার তিন তরুণ রুদ্র মাহামুদ (২০), মুরাদ গাজী (২২) ও নাঈম হাওলাদার (২২) গত ২৮ মার্চ গোপালগঞ্জ-পয়সারহাট মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল।

নিহত নাঈম হাওলাদারের বাবা নওশের আলী হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলেরও মোটরসাইকেল আছে। নাঈম হেলমেট পরেই মোটরসাইকেল চালাতেন। তবে সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে বের হওয়ার সময় হেলমেট ছিল না। বাবা বলেন, হেলমেটটা থাকলে হয়তো ছেলে সেদিন বেঁচে যেত।

প্রথম আলোয় গত ১২ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীর মাথায় হেলমেট ছিল না।

মহাসড়কে হেলমেটবিহীন অবস্থায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন এক তরুণ। গতকাল বেলা তিনটায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাতুয়াইল এলাকায়
ছবি: দীপু মালাকার

জাপানি মোটরসাইকেল কোম্পানি ইয়ামাহা ও বাংলাদেশে তাদের পরিবেশক এসিআই মোটরস প্রতিষ্ঠিত ইয়ামাহা রাইডিং একাডেমির জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক শেখ নোমান রাহুল প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল চালাতে ভালো মানের হেলমেটের বিকল্প নেই। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ভালো মানের হেলমেট মাথাকে অনেকটা সুরক্ষা দেয়। তিনি বলেন, এখন যে প্লাস্টিকের পাতলা হেলমেট দেখা যাচ্ছে, তা পরা হয় পুলিশের জরিমানা এড়ানোর জন্য। এসব হেলমেট সুরক্ষা দেয় না। স্বীকৃত মান মেনে তৈরি হেলমেটের ব্যবহার করতে হবে। বাড়তি সুরক্ষার জন্য পায়ে, বুকে ও হাতে পরার মতো বিভিন্ন সামগ্রী রয়েছে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঠিক প্রশিক্ষণ ও নির্দেশিকা না মানায় দুর্ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে শেখ নোমান রাহুল আরও বলেন, মোটরসাইকেল চালানো সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে।

‘ভুক্তভোগী হয় পুরো পরিবার’

জেলা-উপজেলা থেকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অনেক রোগীকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়। গত সোমবার পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, হূমায়ুন কবির নামের একজনকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরকে নিয়ে আসা হয়েছে নরসিংদী থেকে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত। পা ভেঙেছে।

পরিবারের সদস্যরা জানান, বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেল নিয়ে হূমায়ুন প্রায়ই ঘোরাঘুরি করে। সোমবার মোটরসাইকেল চালানোর সময় সে একটি ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়। সে সময় তার মাথায় হেলমেট ছিল না।

সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগ রোগী যায় পঙ্গু হাসপাতালে। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা জানান, ঢাকার বাইরের রোগীই সবচেয়ে বেশি।

সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীদের চিকিৎসা হয় রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে। হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ জানায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে যেসব রোগী আসেন, তার ৫০ শতাংশই মোটরসাইকেলের চালক বা আরোহী। এঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ আসেন ঢাকার বাইরে থেকে।

ঢাকার বাইরে থেকে যেসব রোগী আসেন, তাঁদের অবস্থা খুবই গুরুতর হয় জানিয়ে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক বদরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীর অনেক জটিলতা থাকে। যাঁদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি, তাঁরা পক্ষাঘাতগ্রস্ত, প্রতিবন্ধিতা, কথা বলতে না পারার মতো সমস্যায় পড়েন। পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তির এই হাল হলে পুরো পরিবারই তার ভুক্তভোগী হয়।