রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালে কার্যকর সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা করোনায় আক্রান্ত এবং করোনায় আক্রান্ত নয়, এমন ব্যক্তিদের শুরুতে পৃথক করা হচ্ছে না। রাজধানীর সাতটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বাছাই করা বা পৃথক করার স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতি ‘ট্রিয়াজ’ নামে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) করোনা রোগীদের বাছাই করার নির্দেশিকা তৈরি করেছে। কিন্তু সেই নির্দেশিকা মেনে কাজটি ঠিকমতো করা হচ্ছে না। এতে হাসপাতাল থেকে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা। আমাদের হাসপাতালগুলোতে দুর্ভাগ্যবশত তা অনুসরণ করা হয় না। কোভিড-১৯–এর কারণে সংক্রমণের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এই সুযোগ আমাদের কাজে লাগানো উচিত।’
শনিবার প্রথম আলোর পক্ষ থেকে রাজধানীর সাতটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ২৫০ শয্যার যক্ষ্মা হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলোজি, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালগুলোর কোনোটিতেই কার্যকর রোগী বাছাই ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল শাখা) ডা. মো. ফরিদ আহমেদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে রোগী বাছাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা হাসপাতালে সঙ্গনিরোধের ব্যবস্থা আছে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) বলছে, বাংলাদেশের সরকারি–বেসরকারি সব হাসপাতালের জরুরি ও বহির্বিভাগে রোগী বাছাই বা ট্রিয়াজ ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য এই পদ্ধতি বলবৎ থাকা দরকার। সিডিসি এ বিষয়ে নির্দেশিকাও প্রকাশ করেছে। সিডিসির পরিচালক অধ্যাপক শাহনীলা ফেরদৌসী প্রথম আলোকে বলেন, এই নির্দেশিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বাছাই করা বা পৃথক করার স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতি ‘ট্রিয়াজ’ নামে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) করোনা রোগীদের বাছাই করার নির্দেশিকা তৈরি করেছে। কিন্তু সেই নির্দেশিকা মেনে কাজটি ঠিকমতো করা হচ্ছে না। এতে হাসপাতাল থেকে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে কে করোনা রোগী, কে করোনা রোগী নয়, তা কীভাবে বাছাই করা হবে, সেই পদ্ধতি ছকের মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেখানো আছে সিডিসির নির্দেশিকায়। আক্রান্ত রোগীর মাধ্যমে অন্য রোগী, রোগীর সঙ্গে আসা ব্যক্তি বা হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ যেন না ছড়ায়, সেই জন্য এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
রোগী বাছাই হচ্ছে না
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে রাজধানী ছাড়াও সারা দেশ থেকে রোগীরা আসেন চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য। করোনার কারণে কয়েক মাস রোগী কম এলেও হাসপাতালগুলোতে দুই মাস ধরে ভিড় বাড়ছে। এসব হাসপাতালের বহু চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে মনে করেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
গতকাল সকাল ১০টায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে গিয়ে রোগীর ভিড় চোখে পড়ে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে, বহির্বিভাগে, টিকিট কাউন্টারসহ বিশেষায়িত এই হাসপাতালের সব বিভাগে ভিড় ছিল। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয় গুরুত্ব পেতে দেখা যায়নি।
হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা। আমাদের হাসপাতালগুলোতে দুর্ভাগ্যবশত তা অনুসরণ করা হয় না। কোভিড-১৯–এর কারণে সংক্রমণের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এই সুযোগ আমাদের কাজে লাগানো উচিত।
রোগী বাছাই বা ট্রায়েজের বিষয় জানতে চাইলে হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক মো. বদরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে আমরা রোগী ভর্তি করে নিই। করোনায় আক্রান্ত কি না, তা দেখা হয় না। সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে জানি। তবে ট্রিয়াজের পুরো পদ্ধতি অনুসরণ করতে গেলে স্ট্রোকের রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে, এটাও মানতে হবে।’
দেশের সবচেয়ে বড় চোখের হাসপাতাল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবনে ঢুকেই মানুষ টিকিট কিনছেন। টিকিট কেনার সময় শুধু জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, কোন বিভাগে (গ্লুকোমা, ছানি বা অন্য সমস্যা) যেতে চান। এরপর হাসপাতালে আসা মানুষেরা টিকিট নিয়ে নির্দিষ্ট বিভাগে যাচ্ছেন। শুধু অস্ত্রোপচারের রোগীদের করোনা পরীক্ষা এই হাসপাতালে বাধ্যতামূলক। দৈনিক গড়ে ৫০ জনকে করোনা পরীক্ষা করা হয়। হাসপাতালের পেছনের দিকে জেনারেটর রাখার জায়গায় এই পরীক্ষার নমুনা নিতে দেখা গেছে।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পাশেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট যক্ষ্মা হাসপাতাল। যক্ষ্মা হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবু রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে ট্রিয়াজ বলতে যা বোঝায়, তা এই হাসপাতালে হচ্ছে না। বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালে হচ্ছে না। হাসপাতালগুলো ট্রিয়াজ বা সংক্রমণ প্রতিরোধ করার বিষয় মাথায় রেখে তৈরি করা হয়নি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে।
প্রতিটি হাসপাতালে মাস্ক পরার নির্দেশনা দেওয়া আছে, বলা আছে মাস্ক না পরলে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাবে না। এর মধ্যে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি কর্তৃপক্ষের একটি সতর্কবার্তা চোখে পড়ে প্রতিষ্ঠানের বহির্বিভাগে। তাতে লেখা—‘গত ১৪ দিনের মধ্যে জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ দেখা দিলে বা সম্প্রতি করোনা উপদ্রুত দেশ ভ্রমণের ইতিহাস আছে এমন ব্যক্তিবর্গ টিকিট সংগ্রহের পূর্বে অবহিত করুন।’ নোটিশটি ছোট কাগজে লেখা, চোখ এড়িয়ে যায়। এই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেছেন, ডায়ালাইসিস প্রয়োজন, এমন রোগীর ক্ষেত্রে করোনা পরীক্ষা এই হাসপাতালে বাধ্যতামূলক।
একই পরিস্থিতি দেখা গেছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ট্রিয়াজের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা চোখে পড়েছে। হাসপাতাল ভবনে ঢোকার মুখে বারান্দায় রোগী বাছাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামনে লেখা আছে, ‘রোগী বাছাইয়ের স্থান’। ‘কোভিড ট্রিয়াজ রুম’।
তবে এই হাসপাতালেও ট্রিয়াজ ঠিকমতো হয় না, এমন কথা বলেছেন একাধিক চিকিৎসক। হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. সাইদুজ্জামান বলেন, খুব কম মানুষ ট্রিয়াজের আওতায় আসে। রোগীরা দেখা যায় টিকিট নিয়ে সরাসরি দাঁতের চিকিৎসকের কাছে চলে যান। তিনি বলেন, ঠিকভাবে ট্রিয়াজের জন্য হাসপাতালে রোগী ঢোকা ও বের হওয়ার পৃথক পথ দরকার। সে রকম হাসপাতাল দেশে দেখা যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন, বর্তমান হাসপাতাল কাঠামোতে রোগী বাছাই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা কঠিন। নতুন হাসপাতাল ভবন করার সময় বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তবে দেশের সব হাসপাতাল রাতারাতি বদলে ফেলা যাবে না। হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, এই কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নজরদারি বাড়াতে হবে।