>• গায়েবি মামলা আসামিরা আগাম জামিন নিতে আসছেন হাইকোর্টে
• বৃদ্ধ, নিরীহ ও শ্রমজীবী মানুষেরা নজরে পড়ছেন
• গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেড় মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ১৮২টি গায়েবি মামলা হয়েছে
• এসব মামলায় ৮৮ হাজার জনের নাম উল্লেখ আছে
রাজধানীতে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনের বড় গাছগুলোর তলায় মানুষের ছোট ছোট জটলা। ময়মনসিংহের গৌরীপুর ও মুক্তাগাছা, নেত্রকোনার বারহাট্টা, সিলেটের গোয়াইনঘাট, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, যশোরের মনিরামপুর, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, ঢাকার উত্তরাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন তাঁরা। প্রতিটি জটলায় আলোচনার বিষয় গায়েবি মামলা। তাঁরা সবাই আসামি; এসেছেন জামিন নিতে। অনেকের পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। কারও হাতে পোঁটলা; তাতে বিস্কুট, চিড়া-মুড়ি বা পানের ডিব্বা। কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চুল-দাড়ি সাদা।
কিছু সময় পরপর কেউ একজন এসে হাঁক ছাড়েন। তারপর দল বেঁধে ছোটেন জটলার মানুষেরা। ‘গৌরীপুর, গৌরীপুর-সব আউয়াইন’। ২৫-৩০ জনের দলটি গাছতলা থেকে আদালত ভবনের দিকে হাঁটা ধরে।
যশোরের মনিরামপুরের শহীদুল্লাহ সরদারের সঙ্গে দেখা হলো হাইকোর্ট চত্বরে। নাশকতার ষড়যন্ত্র ও বিস্ফোরক মামলায় আসামি হয়েছেন। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ, বয়স সত্তরের কোঠায় বলে জানালেন। তবে মামলায় লেখা ৫৫।
মামলায় কী অভিযোগ আনা হয়েছে, জানতে চাইতেই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে শহীদুল্লাহ বলেন, ১৪ জানুয়ারি ঝাপা গ্রামে তাঁর বাড়ির পাশের বালুর গাদায় খেলতে গিয়ে চার ও পাঁচ বছর বয়সী দুই নাতি ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়। শিশু দুটিকে ১০ দিন হাসপাতালেও থাকতে হয়েছে। পুলিশ ২২ জনের বিরুদ্ধে নাশকতার ষড়যন্ত্র ও বিস্ফোরণের অভিযোগে মামলা করেছে। সেই মামলায় এক নম্বর আসামি শহীদুল্লাহ। ওই মামলায় জামিন নিতে শহীদুল্লাহর সঙ্গে এসেছেন আরও ৯ জন।
তাঁদের মতো নাশকতা ও বিস্ফোরক মামলায় আসামি হয়ে কয়েক শ লোক গতকাল সোমবার জামিন নিতে এসেছিলেন হাইকোর্টে। বিএনপি দাবি করে আসছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেড় মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ১৮২টি গায়েবি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৮৮ হাজার জনের নাম উল্লেখ আছে। আর আসামি করা হয়েছে পৌনে তিন লাখ ব্যক্তিকে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে আসা আশি-ঊর্ধ্ব আমির হামজাও নাশকতা মামলার আসামি। তাঁর সঙ্গে একই মামলার আসামি মধ্য ষাটের আবদুল আলিম। তাঁরা জানান, নির্বাচনের আগে পুলিশের ওপর হামলা, নাশকতার অভিযোগে ৭৪ জনের বিরুদ্ধে শাহজাদপুর থানায় একটি মামলা হয়েছে। জামিন নিতে গতকাল তাঁরা ২৪ জন ঢাকায় এসেছেন। জামিনও পেয়েছেন।
আমির হামজা বলেন, তিনি কৃষক। আগেও রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, ‘এখন ইরি ধানের মৌসুম। আর আমাগেরে এহন এই কোর্ট-কাচারিতে চক্কর দিতে হচ্ছে।’
আমির হামজার সঙ্গে আসা লোকজন জানান, বাসে ও মাইক্রোবাসে তাঁরা সবাই এখানে এসেছেন। আসা-যাওয়ার খরচ তাঁদের। আর মামলা পরিচালনার বিষয়ে বিএনপির একজন নেতা সাহায্য করছেন।
অ্যানেক্স ভবনের ঠিক সামনেই হাঁটাপথের ওপর গোল হয়ে বসেছিলেন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি পরা কয়েকজন। তাঁরা এসেছেন সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে। জানালেন, নির্বাচনের দিন সহিংসতার অভিযোগে গোয়াইনঘাট থানায় ১০১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। সেই মামলার ২০ জন আসামি এসেছেন জামিনের জন্য। সবাই নিম্ন আয়ের; কৃষি অথবা পাথর কোয়ারির শ্রমিক। আসামিদের মধ্যে তাজিমুল আলীর বয়স ষাটের ওপর।
তাজিমুল বলেন, তাঁদের বাড়ি গোয়াইনঘাটের যাত্রাবা গ্রামে। সেখানে নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্রে মারামারি হয়েছে বলে শুনেছেন। এরপর তিনি ও তাঁর চার ছেলেকে ওই মামলার আসামি করা হয়েছে বলে জানতে পারেন। কথা বলার সময় তাজিমুলের দন্তহীন মুখ থেকে পানের রস গড়িয়ে পড়ছিল।
গোয়াইনঘাট থেকে আসা লোকজন জানান, তাঁরা সবাই শ্রমিক। কৃষিকাজ করে বা পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। মামলার পর থেকেই তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য বাড়ি বাড়ি আসছে পুলিশ। কেউ বাড়িতে থাকতে পারছেন না, কাজকর্মও করতে পারছেন না। তাঁরা যেহেতু বিএনপি করেন না, তাই বিএনপির নেতারাও তাঁদের সাহায্য করছেন না।
এ প্রসঙ্গে গোয়াইনঘাট পরিদর্শক (তদন্ত) হিল্লোর রায় গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা ওই এলাকার কামাইর কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেন। পুলিশ বাধা দিলে তাদের ওপর আক্রমণ করেন। তাঁর দাবি, বিএনপির নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে হামলা করেছেন। তাই মামলার আসামি হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের পেশার পরিচয়টা মুখ্য বিষয় হয়নি।
এসব মামলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর কর্মকর্তারা নাম উল্লেখ করে কথা বলতে চান না। তবে একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এসব ঢালাও মামলার বিষয়ে নির্দেশনা আসবে বলে তাঁরা শুনেছেন। সে ক্ষেত্রে তদন্ত করে নির্দোষ লোকদের মামলা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে।
তবে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-মিডিয়া) রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ রকম কোনো উদ্যোগের কথা শোনেননি।