হোলি আর্টিজানে অপেক্ষার রাত
>
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের নারকীয় হামলা, আর বাইরে উদ্বিগ্ন স্বজনদের করুণ চাহনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি কামরুল হাসান। এ লেখায় তিনি বলেছেন সেই রাতের ইতিবৃত্ত
ঘন ঘন ফোন আসছে। রিংটোন শুনে এগিয়ে আসা মানুষের অনেক প্রশ্ন, ‘কিছু জানা গেল?’ ‘কেউ কি বেরোতে পারছে?’ ‘জিম্মিকারীরা কি কোনো শর্ত দিল?’ ‘কখন অভিযান হবে?’ কোনো উত্তর দিতে পারি না। ফোন পকেটে রেখে বলি, ‘কেউ কিছু বলতে পারছে না।’ রাতজাগা উদ্বিগ্ন মুখগুলো মলিন হয়ে যায় অজানা শঙ্কায়।
গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে একটি বাড়ির নিচের তলায় আমরা অপেক্ষা করছি। কয়েকটি বাড়ির পরই হোলি আর্টিজান বেকারি। ভেতরে জিম্মি হয়ে আছে অনেক মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ততক্ষণে বাড়িটির চারপাশ ঘিরে ফেলেছেন। আমরা আশ্রয় নিয়েছি নিরাপদ দূরত্বে। আমার সঙ্গে প্রথম আলোর প্রধান আলোকচিত্রী জিয়া ইসলাম, সিনিয়র রিপোর্টার শরিফুল হাসান, নজরুল ইসলাম আর গোলাম মর্তুজা। আছেন জিম্মি হয়ে থাকা কয়েকজনের উৎকণ্ঠিত স্বজন—ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন, বাবা ওয়াকার হোসেন, ভাই যারেফ আয়াত হোসেন, আর তাঁদের আত্মীয় ফয়সল ও হিশাম। তাহমিদের বাবা, ফাইরুজ মালিহার বাবা আর অবিন্তা কবীরের মা-ও পাশে ছিলেন। হাজারো উড়ো খবর আসছে তাঁদের কাছে। সবারই ভরসা হাতের ফোনটি।
গত বছর ১ জুলাই হোলি আর্টিজানে হামলার প্রথম খবর দিয়েছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আজিজা আহমেদ। ঘটনার সময় সম্ভবত তিনি হোলি আর্টিজানের পাশের একটি বাড়িতে ছিলেন। প্রথম খবর ছিল, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা সেখানে হামলা করেছে। এরপর নানা মাধ্যম থেকে খবর আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তিনজন রিপোর্টার দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ঘটনা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। পত্রিকার প্রথম সংস্করণের কাজ শেষে করে যখন ঘটনাস্থলে যাই, ততক্ষণে পুলিশের ওপর হামলা হয়ে গেছে। সেই হামলায় এক পুলিশ নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। র্যাব-পুলিশ-সোয়াট ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলেছে। কাউকে এর ত্রিসীমায় ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছে না। হোলি আর্টিজানের চারপাশের রাস্তা বন্ধ। সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কোনোমতে বেষ্টনীর ভেতরে ঢুকে দেখি, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন চুপচাপ বসে আছেন। কী করতে হবে তাঁরাও কিছু জানেন না। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন। আর হোলি আর্টিজানের ভেতরে কী হচ্ছে, তখনো পর্যন্ত কেউ জানে না।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ভেতরে আটকে থাকা হাসনাত করিম নামের এক ব্যক্তি তাঁর চাচা আনোয়ারুল করিমকে ফোন করেছিলেন। সেই ফোনের সূত্র ধরে তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, হোলি আর্টিজানের ভেতরে লোকজনকে জিম্মি করা হয়েছে। পুলিশ গুলি চালালে সবাইকে মেরে ফেলবে। একটু পর র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বললেন, ‘বিপথগামী লোকজন ভেতরে আছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।’ একটু পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও হঠাৎ নীরব হয়ে যান। হোলি আর্টিজানের উল্টো দিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের বাংলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেই বাংলোর নিচের তলার একটি কক্ষে বৈঠকে বসেন। ততক্ষণে ভেতরে আটকে পড়া লোকজনের স্বজনেরা জড়ো হয়েছেন। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজকর্মে মোটেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। কয়েকজন প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ওদিকে অফিস থেকে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত রিপোর্ট পাঠানোর। আমরা আটকে পড়া লোকজনের স্বজনদের খুঁজতে থাকি কথা বলার জন্য। একটি বাড়ির নিচতলায় ট্রান্সকম গ্রুপের পরিচালক সিমিন হোসেন ও তাঁর বড় ছেলে যারেফ হোসেনকে দেখি। সিমিন হোসেনকে প্রথম দেখায় বিহ্বল হয়ে যাই। তাঁর পরনে একেবারে ঘরে পরার পোশাক, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। পোশাকের সঙ্গে সাদৃশ্য না থাকা আটপৌরে ওড়না দিয়ে অনবরত ঘেমে ওঠা মুখ মুছে যাচ্ছেন। তাঁর বিবর্ণ চেহারার দিকে তাকাতেই এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন ভেতরের কোনো খবর জানি কি না। বললেন, তাঁর ছোট ছেলে ফারাজ ভেতরে আটকে আছে। কেমন আছে, কিছুই জানেন না। একটু দূরে ছিলেন যারেফ। তাঁর চোখেমুখে চরম হতাশার ছাপ। তিনি খুব সতর্কতার সঙ্গে মাকে আগলে রেখে নানা কথায় সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
মাঝরাতের পর পুলিশ কর্মকর্তারা হাল ছেড়ে দেন। উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ আসে রাতে আর অভিযান হবে না। সকালে কমান্ডোরা আসবে, তারা অভিযান চালাবে। পুলিশের কাজ শুধু পাহারা দেওয়া। অভিযানের জন্য কেন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তা নিয়ে আটকে পড়া মানুষের স্বজনেরা আবারও ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে উচ্চ স্বরে কথা বলতে বলতে হোলি আর্টিজানের দিকে ছুটে যান কেউ কেউ। কিন্তু পুলিশের ব্যারিকেড থামিয়ে দেয় সে গতি। একপর্যায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। হতাশ স্বজনেরা ফিরে আসেন। রাত যত বাড়তে থাকে, স্বজনদের উৎকণ্ঠাও বাড়তে থাকে তত।
একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আসতে দেখে এগিয়ে যান আফতাব গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার খান। মুঠোফোনে একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, ভাই এটা আমার ছেলে। কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। একটু দেখবেন তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় কি না। পুলিশ কর্মকর্তা মাথা নেড়ে যান। অবিন্তা কবীরের মা নিরবে সব শুনছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন, আমাদের সন্তানেরা আটকে আছে, কী হচ্ছে আমরা জানব কি করে? পুলিশ কর্মকর্তা কোনো জবাব দেন না।
রাত আড়াইটার দিকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের মুখপাত্র ‘আমাক’ নিহত ব্যক্তিদের ছবিসহ খবর প্রকাশ করে। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান আবুল কালাম আজাদ তখন ঘটনাস্থলে। তাঁকে ফোন করে বিষয়টি বলতেই তিনি জানান, ভেতরে ২০ জন নিহত হয়েছেন বলে তাঁরা খবর পেয়েছেন। ফোন রেখে ২০ জন নিহত ব্যক্তির কথাটি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সিমিন হোসেন ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বারবার জানতে চান, কে এই খবর দিল, কতটা সত্যি সে খবর। আমি উদ্বিগ্ন ও অসহায় মায়ের এই ব্যাকুলতার কাছে হার মানি। মিথ্যে করি বলি, ‘যাঁরা বলছেন, তাঁরা ধারণা থেকে বলছেন। হয়তো সেটা ঠিক নয়।’ কিন্তু তিনি নাছোড়। এগিয়ে আসেন যারেফ, তিনি মাকে বুঝিয়ে শান্ত করেন।
শেষ রাতে সিলেট থেকে ঢাকায় আসে বিশেষ কমান্ডো বাহিনী। তখন হোলি আর্টিজানের চারপাশে আরও কড়াকড়ি। সাংবাদিকসহ সবাইকে বের করে দেওয়া হয় ৭৯ নম্বর সড়ক থেকে। আমরা ওই বাড়ির ফটক ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে যাই। বৃষ্টি আরও বাড়তে থাকে। হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। একটি করে গুলির শব্দ হতে না হতেই আর্তনাদ করে ওঠেন সিমিন হোসেন। বারবার জানতে চান, ‘কিসের শব্দ’, ‘কী হচ্ছে ওখানে।’ আমরা কিছু বলতে পারি না।
এভাবে ধীরে ধীরে সকাল হয়। গুলির আওয়াজ থেমে গেছে। ভেতরে কমান্ডো অপারেশন শেষ। হঠাৎ শাহরিয়ার খানের ফোন বেজে ওঠে। একটি নম্বর থেকে ছেলে তাহমিদ ফোন করেছেন। ছেলের কণ্ঠ শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানালেন, যাঁরা জীবিত ছিলেন, তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে। এখন আর ভেতরে কেউ বেঁচে নেই। যাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ফারাজ নেই।
আমি খবর শুনে কথা হারিয়ে ফেলি। কী করব ভাবতে পারছি না। জিয়ার সঙ্গে আলাপ করি। জিয়াও কিছু বলতে পারেন না। ফোন করি প্রথম আলো সম্পাদককে। তাঁকে সব খুলে বলি। তিনিও অসহায় বোধ করেন। কী করে এক মাকে এই খবর দেব, ভেবে পাই না। খুব অসহায় লাগে নিজেকে।
সিমিন হোসেন বারবার বলছিলেন, ‘আমার ছেলের খোঁজটা এনে দেন।’ আমি আর জিয়া তাঁর মুখের দিকে তাকাই। যারেফ আড়ালে গিয়ে চোখ মুছে এসে মায়ের সামনে স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করেন, ‘অত চিন্তা কোরো না, মা।’ আমরা নীরব হয়ে থাকি। আমাদের নীরবতার ভেতরে তিনি হয়তো সত্যিটা খুঁজে পান। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না। পানির অঝোর ধারা চোখ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মায়ের শেষ ভরসাটুকু।