দুর্যোগ
হঠাৎ বন্যায় বড় বিপর্যয়
ভারতের মেঘালয় ও আসামে অতিভারী বৃষ্টির কারণে ঢল নেমে আসছে বাংলাদেশে। মোট ১৭ জেলায় বন্যার আশঙ্কা।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুন মাসের বৃষ্টিপাতের বিবেচনায় এটা ১২২ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি)। শুধু মেঘালয় নয়, তিন দিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে ভারতের আসামেও।
মেঘালয়ের বৃষ্টির পানি এসে সিলেট বিভাগে হঠাৎ বড় বন্যা সৃষ্টি করেছে। এই বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ সুনামগঞ্জে। জেলাটির ৯০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। ওদিকে আসামের বৃষ্টির পানি ঢল আকারে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এতে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও রংপুরের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মৌসুমি বায়ু হঠাৎ করে তীব্র শক্তি নিয়ে হিমালয়ের উঁচু পাহাড়গুলোতে আছড়ে পড়ছে, যা ভারী বৃষ্টি তৈরি করছে। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বলছে, আগামী দুই থেকে তিন দিন ভারী বৃষ্টি চলতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে উজান থেকে পানি আসা বন্ধ হবে না। সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির আশা নেই। দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী দুই দিনের মধ্যে আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতি আরও দু-তিন দিন ধরে অবনতি হতে পারে। উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিরও দ্রুত অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, উজানে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও বৃষ্টি চলছে।
সিলেটে বিপর্যয়
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিলেট বিভাগের বন্যা এর আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। উজান থেকে আসা ঢলে এই বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা এখন পানির নিচে। সুনামগঞ্জ কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেখানে বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি নেই, মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই। সিলেট বিভাগের বাকি জেলাগুলোর শহরের কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। টিনের ছাউনির ঘর ও একতলা ভবনের ছাদ পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে এর কাছাকাছি পর্যায়ের বন্যা সিলেট বিভাগে হয়েছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহর বন্যাকবলিত হয়। তখন পানি স্থায়ী হয়েছিল দু-তিন দিন। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা এর আগে হয়নি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে।
সিলেট বিভাগে বন্যা এতটা তীব্রতা পাওয়ার কারণ, পানি নামতে বাধা পাচ্ছে। হাওরে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে পানি দ্রুত সরতে পারছে না।সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
বন্যার শঙ্কা
মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। সেখানে গত তিন দিনে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চেরাপুঞ্জিতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে আসামের গুয়াহাটিতে বৃষ্টি হতে পারে ৩০০ মিলিমিটার। ওই দুই এলাকার ভাটি এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের সিলেট ও কুড়িগ্রামে পানি নামা শুরু করবে। অন্যদিকে পদ্মার মূল নদী গঙ্গার উজানে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তা আরও বাড়তে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এক পূর্বাভাসে জানায়, আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বন্যাকবলিত হতে পারে। পদ্মা নদীর পানি বেড়ে মধ্যাঞ্চলের চারটি জেলায়ও বন্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে। উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা স্থায়ী হতে পারে ৭ থেকে ১০ দিন।
এ মাসে সব মিলিয়ে ১৭টি জেলা বন্যাকবলিত হতে পারে। সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ ছাড়া বন্যা হতে পারে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, পাবনা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর ও ফরিদপুরে।
এদিকে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় গতকাল সকালে বৃষ্টি শুরু হয়। রাজধানীতে গতকাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ২১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে সন্দ্বীপে, ২৬১ মিলিমিটার। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল ও খুলনা বিভাগের কয়েকটি স্থানে এবং দেশের বাকি এলাকার বেশির ভাগ স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে।
বন্যা এত তীব্র কেন
বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশির ভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। এতে বৃষ্টির পানির ঢল দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। হাওর এলাকায় অবকাঠামোসহ নানা কারণে পানি দ্রুত সরে যেতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গতকাল সকাল ছয়টায় সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সামনে সুরমা নদীতে সেকেন্ডে ১২ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। পানির উচ্চতা বিপৎসীমার প্রায় ১ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। স্বাধীনতার পর আর কখনো দেশের ওই এলাকায় এত উঁচু দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট বিভাগে বন্যা এতটা তীব্রতা পাওয়ার কারণ, পানি নামতে বাধা পাচ্ছে। হাওরে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে পানি দ্রুত সরতে পারছে না।