স্মৃতির আলোয় অরুণ–স্মরণ
শোক ও শ্রদ্ধায় প্রিয় ‘অরুণদা’কে স্মরণ করলেন প্রথম আলোর কর্মীরা। দীর্ঘদিনের সহকর্মী প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক অরুণ বসু করোনায় আক্রান্ত হয়ে অনেকটা আকস্মিকভাবেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন ৭ অক্টোবর। তাঁর প্রয়াণ ব্যথিত করেছে সবাইকে। আজ সোমবার তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে সেই সশ্রদ্ধ শোকের কথা বললেন অরুণ বসুর স্মরণসভায়।
বিকেলে প্রগতি ভবনের সপ্তম তলায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে এ স্মরণসভা শুরু হয় এক মিনিট নীরবতা পালন করে। প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগ ও প্রথমা প্রকাশনের কর্মীরা ছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন অরুণ বসুর স্ত্রী কবিতা গোস্বামী, ছেলে মেঘমল্লার বসু, ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন ভাই বরুণ বসু, শিশু সংগঠন ফুলকির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আজম, বন্ধু নিমাই গাঙ্গুলি, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক কুদরত–ই–হুদাসহ অনেকে। স্মৃতিচারণা শুরুর আগে ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গানটি গেয়ে শোনান প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। এরপর অরুণ বসুকে নিয়ে নির্মিত একটি ছোট প্রামাণ্যচিত্রও দেখানো হয়।
আলোচনায় সহকর্মীরা অরুণ বসুর সঙ্গে তাঁদের নানা সময়ের স্মৃতিচারণা করেন। এ সময় ব্যক্তি অরুণকে ছাপিয়ে যায় তাঁর গুণ, ব্যক্তিত্ব, স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য। সহকর্মীরা বলেন, সবাইকে তিনি দ্রুত আপন করে নিতে পারতেন। প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছেন, সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থেকেছেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি অবদান রেখেছেন। সহকর্মীরা তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন।
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রথমা থেকে প্রকাশিত তাঁর বইগুলোর পাণ্ডুলিপি লাইন ধরে ধরে পড়ে নানাভাবে পরিমার্জনা করেছেন অরুণ বসু। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁরা যুক্তি দিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খুব কঠিন এ কাজ তিনি খুব যত্নের সঙ্গেই করে গেছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে এ ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
ফরিদপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত অরুণ বসু ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। শিশু সংগঠন ফুলকির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আজম বন্ধু অরুণের সাংগঠনিক দক্ষতা, তাঁর দানশীলতা ও ফরিদপুর থেকে ঢাকা এবং কলকাতায় সাহিত্য–সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে অসামান্য যোগাযোগর বিষয়টি তুলে ধরেন।
স্ত্রী কবিতা গোস্বামী শোকাহত অবস্থায় স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে স্বামীর মহৎ হৃদয়ের বিষয়টিকেই সামনে এনেছেন। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অরুণ বসুর হাতে তাঁদের বিয়ের যে আংটি ছিল, একদা তিনি দেখেন সেটি নেই। অরুণ স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। পরে তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন এক বন্ধুর ভাই বিদেশ পড়তে যাবে, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু টাকার ঘাটতি হয়েছিল। অরুণ বসুর কাছে এলে তিনি হাতের আংটি খুলে দিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের বন্যায় বহু অনাহারী ও নিরাশ্রয় মানুষকে তিনি ফরিদপুরে তাঁদের বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছেন। অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। অরুণ বসুকে তাঁর স্ত্রী অভিহিত করেছেন ‘আমার রাজা’ বলে।
দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বর্তমানে প্রকাশনা সংস্থা বাতিঘরের প্রধান নির্বাহী জাফর আহমদ রাশেদ স্মৃতিচারণায় বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চার বিকাশে প্রথম আলোর উদ্যোগগুলোর সঙ্গে অরুণ বসুর যুক্ততা এবং আন্তরিক পরিশ্রমের কথা স্মরণ করেন। দীর্ঘদিনের সহকর্মীর কাছ থেকে তিনি নিজেও বিভিন্ন বিষয়ে শিখেছেন, ঋদ্ধ হয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, অরুণ বসুর মৃত্যু হলেও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।
প্রথম আলো বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চার ভেতর দিয়ে ভাষার উৎকর্ষ সাধনের যে চেষ্টা করছে ‘ভাষা প্রতিযোগ’সহ বিভিন্ন আয়োজনে, অরুণ বসু তাতে বিশেষ অবদান রেখেছেন। অফিসের প্রতিটি বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে তিনি নিজে থেকেই নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। মানুষের বিপদে–আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বভাব ছিল তাঁর। খুব ভালো গল্প লিখতেন। আর তাঁর আবৃত্তির অনুরাগী কে নয়, অথচ নিজের সম্পর্কে তিনি বরাবর নীরবই থেকেছেন। সহৃদয়, সদালাপী এহেন অরুণ বসুকে হঠাৎ হারিয়ে সহকর্মীরা তাঁর এসব গুণপনার কথাই বলছিলেন ঘুরেফিরে। আলোচনা করলেন যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়া, প্রথমার জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুলিপি সম্পাদক আখতার হুসেন, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন। আবৃত্তি করেন প্রথম আলোর সোশ্যাল মিডিয়া প্রধান জাভেদ হুসেন। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান সমাপনী বক্তব্যে বলেন, অরুণ বসুর সঙ্গে দাপ্তরিক এবং ব্যক্তিগত—দুই ধরনের সম্পর্ক ছিল তাঁর। দাপ্তরিক কাজের বাইরে বহু সময় পারিবারিক পরিবেশে, ব্যক্তিগত বিষয়–আশয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে।
শিল্প–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অরুণ বসুর মতো বহুমাত্রিক গুণবান মানুষ ক্রমেই কমে আসছে। এই মানুষদের শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি করোনায় অকালে চলে যাওয়া প্রথম আলোর আরেক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মিজানুর রহমান খানের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম আলোয় মিজানুর রহমান খানের লেখাগুলো নিয়ে তিনটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলে যাওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতের স্মৃতির স্মরণ করে তিনি বলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন প্রথম আলোর লেখক, শুভানুধ্যায়ী, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ মানুষ। সব সময় তাঁদের অভাব বোধ হবে।
প্রিয় সহকর্মীর স্মৃতিচারণায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। প্রথম আলো সম্পাদক আহ্বান জানান অরুণ বসু তাঁর সামগ্রিক কর্মের ভেতর দিয়ে যে অবদান রেখেছেন, তার জন্য আসুন আমরা সবাই তাঁকে করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করি। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে স্মৃতিতর্পণের এই বিষণ্ন বিকেলকে বিপুল করতালিতে মুখর করে তোলেন।