স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রয়োজন সবার সমর্থন ও সম্মাননা
৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস উপলক্ষে ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) ও প্রথম আলোর যৌথ আয়োজনে ‘স্বেচ্ছাসেবার সাফল্য এবং এর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২১ ডিসেম্বর ২০২০। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও ইভেন্টের প্রধান মুনির হাসান
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস হিসেবে স্বেচ্ছাসেবার সাফল্য ও এর প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ভিএসও এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে সবাইকে স্বাগত জানাছি৷ বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যেকোনো সামাজিক সমস্যা নিয়ে যাঁরা সব সময় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যান, তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর জন্য প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস পালিত হয়। এ বছরের শুরু থেকে স্বেচ্ছাসেবা সম্মাননা ২০১৯–কে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রায় ১১টি আয়োজন হয়েছে। ভিএসও এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে এ বছর আরও কিছু কার্যক্রম হওয়ার কথা থাকলেও মহামারি পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব না হলেও তারই ধারাবাহিকতায় এই বৈঠক।
সালাহ্উদ্দিন আহমেদ
প্রজেক্ট ইমপ্লিমেনটেশন লিড, ভিএসও
গত বছর থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনের পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব না হলেও আজ ভার্চ্যুয়ালি এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবা সময় কাটানোর ভালো মাধ্যম। অনেকে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। বাংলাদেশের আনাচকানাচে অনেক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। তাদের সবার কাছে যেন পৌঁছানো যায়, তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা যায়, সে কারণেই এ উদ্যোগ।
ভিএসও বাংলাদেশে কাজ করছে ১৯৭৪ সাল থেকে। ভিএসও কাজ করছে শিক্ষা, জীবিকা ও স্বাস্থ্য নিয়ে। এ ছাড়া আরেকটা মূল লক্ষ্য হলো তরুণদের কাজে লাগানো। তারা যেন নিজ এলাকা থেকে কাজ করতে পারে৷ কিন্তু স্বেচ্ছাসেবা কাজের ক্ষেত্রে প্রতি পদে প্রতিবন্ধকতা। আমরা মনে করি, স্বেচ্ছাসেবাটাকে যদি একটা নীতিমালার মধ্যে আনা যায়, তাহলে আমরা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজটা আরও সহজে করতে পারব।
আখতারুজ্জামান খান কবির
মহাপরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর
কোভিড পরিস্থিতি আমাদের জীবনযাপন কঠিন করে দিলেও এই সময়ে এসে স্বেচ্ছাসেবকদের অন্য রকম একটি দিক চোখে পড়েছে৷ বিশ্বব্যাপী মহামারিতে তারা স্বেচ্ছায় বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে৷ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ১৮ থেকে ৩৫ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। স্বেচ্ছাসেবকেরা বিভিন্ন বিষয়ে বাধার সম্মুখীন হয়। তার মধ্যে একটি হলো স্বেচ্ছাসেবক ধরে রাখা। তবে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় স্বেচ্ছাসেবকদের তাদের পেশাগত জীবনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পেশাগত জীবনের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবার কোনো বিরোধ নেই। দ্বন্দ্বের বদলে বরং পেশাগত দক্ষতা দিয়ে সেবা প্রদান করতে পারলে সেবার মান আরও ভালো হয়। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদান না করা একটি বড় বাধা৷ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজগুলো আরও শক্তিশালী ও সাবলীল হয়। ২০১৭ সালে ন্যাশনাল ইউথ পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে, যা যুবকদের জন্য খুবই কার্যকর নীতিমালা; যা অনুসরণ করলে তরুণদের কাজগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
জাভেদ পারভেজ
প্রতিষ্ঠাতা, ড্রিমস ফর টুমরো
ড্রিমস ফর টুমোরো একটি সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছে। ২০০৯ সালে রংপুরে এর যাত্রা। বর্তমানে শিক্ষাটা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছেছে খুব ভালোভাবেই। কিন্তু শিশুরা আসলে একটি প্রথাগত শিক্ষার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের কাজটি শিশুদের মধ্যে পড়াশোনার পাশাপাশি মূল্যবোধ শিক্ষা, নিজের স্বপ্নকে প্রাধান্য দেওয়া ও নেতৃত্বের মনোভাব তৈরি। জীবনের অন্যান্য অঙ্গনের ঘাটতিগুলো পূরণই মূল লক্ষ্য। এ নিয়ে কোভিড পরিস্থিতির আগে আমরা বেশ বড় পরিসরে এগিয়ে গিয়েছিলাম, যা বর্তমানে একটু পিছিয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বড় বাধা হিসেবে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবাটাকে নেতিবাচকভাবে দেখা। আমরা যেকোনো কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে যখন যাই, তখন সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় পরিচয়হীনতায়। তবে আগের চেয়ে এই ব্যাপারটা অনেকটাই কম। এখন স্থানীয় প্রশাসন অনেক উন্নত এবং এই ব্যাপারগুলো সহজে গ্রহণ করে; যা দশ বছর আগেও অতটা সহজ ছিল না। তাই এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকদের সাহস আর অনুপ্রেরণা জোগাতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মতো বড় কোনো জায়গা থেকে যদি সমর্থন আসে, তাহলে কাজ অনেকটাই সহজ হয়।
তুহিন ওয়াদুদ
শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হয়েও কাজ করি প্রকৃতি নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই সবুজ দেখতে ভালো লাগত বলে আমি যেকোনো আয়োজনে উপহার হিসেবেও গাছ দিতাম। সেটা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ হতো অনেক। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার বৃক্ষ রোপণ করেছি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। তা ছাড়া এ বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় পৌনে ২০০ প্রজাতির গাছ লাগিয়েছি। তার মধ্যে কিছু গাছ নষ্ট হয়েছে, অনেক পুরোনো গাছ কাটা পড়েছে। অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি যেহেতু স্বেচ্ছাসেবক, গাছ লাগাতে আমার নিজের সময়, অর্থ, শ্রম ব্যয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও চতুর্দিক থেকে বাধা কম আসেনি৷ যেহেতু আমি নদী রক্ষা নিয়েও কাজ করি, সে ক্ষেত্রে বাধা আসে সবচেয়ে বেশি। দখলদারেরা ভয়ভীতি দেখিয়ে দমিয়ে রাখতে চাইলেও আমি এবং অন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা কেউ দমে যায়নি।
বাদল সৈয়দ
উদ্যোক্তা, পে ইট ফরোয়ার্ড, বাংলাদেশ
পে ইট ফরোয়ার্ড বর্তমানে ৪১ হাজার সুবিধাভোগী রয়েছে। আমাদের মূল কাজ হলো অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিজের অসচ্ছলতার কথা জানিয়ে আবেদন করলে আমরা তাদের তথ্য যাচাই করি এবং তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেবে, এমন একজন দাতা খুঁজে দিই। এই প্রক্রিয়ায় আমরা মাসে ২০ লাখ টাকার মতো বৃত্তি প্রদান করে থাকি অভিভাবকদের মাধ্যমে। এভাবে একজন শিক্ষার্থী নিজে পড়াশোনা করে সামর্থ্যবান হয়ে অন্য একজন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু পে ইট ফরোয়ার্ডের একটাই শর্ত, ভালো মানুষ হয়ে গড়তে হবে। এ ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের দেশের সেরা শিক্ষকদের কাছে পড়ার সুযোগ ছাড়া তরুণ ও বয়স্কদের জন্য আমােদর কায৴ক্রম রয়েছে।
ঈশিতা ঘোষ চৌধুরী
সমন্বয়কারী, ইনোভেটর, সিলেট
আমরা সিলেটের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমরা কাজ করি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই পড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা নিয়ে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এই কাজ করতে গিয়ে আসলে যেমন আনন্দ আছে, তেমনই আছে কিছু বাধা। সে ক্ষেত্রে আমরা সবার কাছে যখন বই পড়ার জন্য নিবন্ধন করতে যাই, তখন আমাদের গ্রহণযোগ্যতাটা কম থাকে। আর বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে যেহেতু সরাসরি কার্যক্রম সব বন্ধ, তাই আমরা চেষ্টা করেছি ভার্চ্যুয়ালি সবার সঙ্গে যুক্ত থাকতে এবং বই পড়ার চর্চাটা অব্যাহত রাখতে।
ড. মুমিত আল রশিদ
সভাপতি, জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ, বন্ধুসভা
সারা বাংলাদেশে ৮৮ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছেন বন্ধুসভায়৷ বন্ধুসভার স্বেচ্ছাসেবক বন্ধুরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন, কর্মশালার মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করে থাকেন। বন্ধুসভার সদস্যরা প্রতি মাসে খোলা মাঠে বসে আলোচনা করতেন, বই পড়তেন। করোনার সময়ে সেটা সম্ভব না হলেও ভার্চ্যুয়ালি সবাই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, একে অপরের পাশে আছেন। স্বেচ্ছাসেবার ক্ষেত্রে অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপ থেকে বা যেকোনভাবে মাথায় আসে স্বেচ্ছাসেবা থেকে কী পাচ্ছি! এ ছাড়া অনেক সময় স্বেচ্ছাসেবকদের অবমূল্যায়ন করা হয়। আবার অনেক সময় অনেক কাজের ক্ষেত্রে সঠিক ধারণা না থাকার কাজ সঠিকভাবে সম্পাদিত হয় না। তাই স্বেচ্ছাসেবকদের আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কিংবা কর্মশালার সুযোগ করে দিতে চাই। তাঁদের বিভিন্ন রকম কোর্স, কর্মশালার সন্ধান দেওয়া হয়। যেগুলো স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে আগ্রহ ও সাহস জোগাতে সহায়তা করে।
নিশাত তাসনীম মৌ
সভাপতি, এসো পড়তে শিখি, রাজশাহী
আমরা কাজ করছি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা নিয়ে। আমরা প্রথমে রাজশাহীতে ৬০ জন শিশু নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে অধিকাংশ শিশুই স্কুলে ভর্তি ছিল না। তাদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। এরপর দেখা গেছে স্কুল থেকে বই পেলেও পড়াশোনার আনুষঙ্গিক খরচ বহন করার সামর্থ্য তাদের ছিল না। আমরা সেগুলোর ব্যবস্থা করেছি। আমরা যেহেতু মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করি, তাই আমরা শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা শুরু করি। কীভাবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা যাবে, সেগুলো সম্পর্কে তাদের এবং তাদের মা–বাবাকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। তবে কাজ করার ক্ষেত্রে যে বাধার সম্মুখীন হয়েছি, তা হলো শ্রমজীবী শিশুদের অভিভাবকদের দ্বারা। তাদের শিক্ষার গুরুত্বটা বোঝাতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে। তাদের একটা স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করা এবং স্বপ্ন পূরণ করায় এগিয়ে দেওয়াই আমাদের কাজ। আমরা তাদের একটা সুন্দর জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে চাই।
মুনির হাসান
আজকের আলোচনায় উঠে এসেছে স্বেচ্ছাসেবার সাফল্যের গল্পগুলো। আরও কিছু বিষয় উঠে এসেছে, তা হলো স্বেচ্ছাসেবকদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো, তাদের সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা করার কথা। স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মাননার আয়োজনটি সম্প্রতি চালু হয়েছে। আশা করা যায়, এটি পরবর্তী সময়ে আরও বড় পরিসরে সবার কাছে পৌঁছে যাবে।
আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ভিএসওর মো. শফিকুর রহমান, ইলিয়াস আলী, অনুপ গুণ এবং ইয়ুথ অপরচুনিটিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন নূর।