স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যাপ্ত করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সংক্রমণ থেকে স্বজনদের দূরে রাখতে মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে চাইছেন। মানুষের সে চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যাপ্ত সংখ্যায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডেও বাংলাদেশ পিছিয়ে।

দেশে সরকারি-বেসরকারি ৬১টি ল্যাবরেটরিতে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষা করাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ অসহায় পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। পরীক্ষার ফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে। আবার ফল নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। দেশে সঠিকভাবে রোগ শনাক্ত হচ্ছে না বলে সংক্রমণ প্রতিরোধে আইসোলেশনসহ (বিচ্ছিন্নকরণ) অন্য অনেক কাজেও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

দেশে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হয় জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। পাঁচ মাস পরে দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলে, সংক্রমণের বর্তমান যে ধারা, তাতে দেশে দৈনিক ২০ হাজার পরীক্ষা হওয়া দরকার। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে দৈনিক ২০ হাজারের বেশি পরীক্ষা করতে হবে।

মহামারির শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে এসেছে। বলেছে, পরীক্ষা করুন, সন্দেহভাজন প্রত্যেক মানুষকে পরীক্ষা করুন। কিন্তু গত পাঁচ মাসের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এই নির্দেশনাকে গুরুত্ব দেয়নি। পরীক্ষার জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না, তারা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ গত ১৮ জুনের সংবাদ বুলেটিনে বলেছিলেন, করোনা পরীক্ষায় জেলা পর্যায়ে আরটিপিসিআর যন্ত্র ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন ও সহজে রোগ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা উপজেলা পর্যায়ে করার চিন্তা চলছে।

সংক্রমণ প্রতিরোধ

সংক্রমণ প্রতিরোধের ঠিক পথে বাংলাদেশ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিরোধের শুরুর দিকের ধাপটি হচ্ছে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা। আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, রোগী শনাক্ত করার জন্য প্রথমে দরকার পরীক্ষা। শনাক্ত হলে তাঁকে আইসোলেশনে নিতে হবে (বিচ্ছিন্নকরণ) এবং চিকিৎসা দিতে হবে।

তবে দেশে আইসোলেশন ঠিকমতো হচ্ছে না। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশ বাড়িতেই থাকছে। তাঁরা ঠিকমতো আইসোলেশনে থাকেন কি না, সে তথ্য সরকারের কাছে নেই। জানার ব্যবস্থাও নেই। একইভাবে তাঁরা বাড়িতে কী চিকিৎসা পাচ্ছেন, সে ব্যাপারেও কোনো নজরদারি নেই। অন্যদিকে হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসা নিচ্ছেন বা নিয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারেও কোনো মূল্যায়ন নেই। আছে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ।

মুশতাক হোসেন বলেছেন, রোগী শনাক্ত করলেই হবে না, তাঁর সংস্পর্শে কারা এসেছিলেন, সেটাও খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, কনট্যাক্ট ট্রেসিং (রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খোঁজা) খুবই দুর্বল অবস্থায় আছে। রোগীই যেখানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।

কনট্যাক্ট ট্রেসিং যেহেতু হচ্ছে না, তাই পরের ধাপটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। পরের ধাপে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি করার জন্য কোয়ারেন্টিন করার (সঙ্গনিরোধ) কথা বলা হয়। রোগী ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বলে কোয়ারেন্টিনও যথাযথ হচ্ছে না।

বর্তমান পরিস্থিতি

মানুষ নমুনা দেওয়ার জন্য রাতভর নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র বা বুথের সামনে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছেন। অসুস্থ মানুষের এই দুর্ভোগের ছবি নিয়মিত গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকে বলছেন, এতে সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।

সংক্রমণের ধারা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন রোগী শনাক্ত করতে যদি ১০ থেকে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা যায়, তা হলে পরীক্ষা পর্যাপ্ত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। সরকারি হিসাবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৫ লাখ ৮২ হাজার ৫৪৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৩৫ জন। অর্থাৎ একজন রোগী শনাক্ত করতে ৫ দশমিক ৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অর্থাৎ ন্যূনতম প্রয়োজনের (১ জন শনাক্তে ১০ জনের পরীক্ষা) চেয়ে ৪ লাখ ৭২ হাজার নমুনা পরীক্ষা কম হয়েছে।

ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভারত ও নেপাল ন্যূনতম প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরীক্ষা করাচ্ছে। ভুটানের একজন শনাক্ত করতে গড়ে ৩৩২ জনের পরীক্ষা হচ্ছে। ভারতে হচ্ছে ১৭ জনের। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবস্থাও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। দেশটিতে একজন শনাক্তে ৬ জনের পরীক্ষা হচ্ছে। শুধু আফগানিস্তানের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। একজন শনাক্ত করতে দেশটিতে ২ দশমিক ২৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

>

করোনা মোকাবিলার শুরুতেই আসে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা
মানুষ পরীক্ষা করাতে আগ্রহী, করাতে পারছেন না

দেশে বর্তমানে ৬১টি ল্যাবের মধ্যে ঢাকায় ৩১টি ও ঢাকার বাইরে ৩০টিতে পরীক্ষা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজে যুক্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা শুরু করেও বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা শহরের বয়স্ক ও গর্ভবতী নারীদের নমুনা বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করছে। এ ছাড়া চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এটা বাস্তব যে এই পরীক্ষা করার মতো আরটিপিসিআর যন্ত্র, রি–এজেন্ট ও কিট এবং জনবলের ঘাটতি ছিল। সহজে এই ঘাটতি পূরণ করা যায় না। কিন্তু একই সঙ্গে পরিকল্পনারও ঘাটতি ছিল। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে পরীক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নত পর্যায়ে থাকতে পারত।

পরিকল্পনার ঘাটতি

শুরু থেকে করোনা পরীক্ষা এককভাবে আইইডিসিআরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষা এবং পরীক্ষার ফলাফল জানানো—সবই করত স্বাস্থ্য বিভাগের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান চালাতে যে জনবল প্রয়োজন, তারও ঘাটতি ছিল আইইডিসিআরে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি–বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের এই যন্ত্র আছে এবং তাদের ল্যাবরেটরি উন্নত মানের। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেয়নি আইইডিসিআর। অনেক সমালোচনার পর তারা একটি-দুটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া শুরু করে। কিন্তু কে বা কারা এই পরীক্ষা বন্ধ করে রেখেছিল, তা এখনো স্পষ্ট করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়।

একপর্যায়ে আইইডিসিআরের কর্তৃত্ব থেকে পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। পুরো করোনা পরীক্ষার সমন্বয়ের দায়িত্ব পান অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। কিট বিতরণ, নমুনা সংগ্রহ ও বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে নমুনা বিতরণের বিষয়গুলো তিনি সমন্বয় করছেন। কিন্তু পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিয়েছে।

ব্যবস্থাপনার সমস্যা

নমুনা সংগ্রহের সমস্যার পাশাপাশি নমুনা সংগ্রহের সময় তথ্য ঠিকমতো রাখা হচ্ছে না। ১৩ জুন আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটের তথ্যে দেখা যায়, ঢাকা শহরে আক্রান্ত ব্যক্তি ২৩ হাজার ৩৯৯ জন। পাশাপাশি ঢাকার মোট ২২২টি এলাকার আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন ১৩ হাজার ১৫৬ জন। অর্থাৎ শুধু ঢাকা শহরের প্রায় ১০ হাজার আক্রান্তের সংখ্যায় গোলমাল। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেছিলেন, তথ্য সংগ্রহের অনেক ফরমে শুধু ঢাকা লেখা থাকে, বিস্তারিত ঠিকানা থাকে না। তাই তথ্য সংগ্রহের ত্রুটির কারণে সংখ্যায় এই হেরফের।

পরীক্ষার সনদেও নানা ত্রুটি হচ্ছে। যেমন একজন সাংবাদিকের কাছে একই প্রতিষ্ঠান থেকে একই দিনে দুই রকম সনদ এসেছে। একটিতে তিনি করোনায় আক্রান্ত (পজিটিভ), অন্যটিতে আক্রান্ত নন (নেগেটিভ)। গত সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক ব্যক্তিকে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে ফোন করে বলা হয়, ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত। পরীক্ষায় পজিটিভ এসেছে। ওই ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নমুনাই দেননি। এ নিয়ে প্রথম আলোর অনলাইনে সংবাদ প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘটনা তদন্ত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল চাহিদার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাল মেলাতে পারছে না বলে নানা অসংগতি দেখা দিচ্ছে। নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।

পরীক্ষা নিয়ে এই দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে জাল সনদ তৈরি শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করছেন পরীক্ষা, আক্রান্ত ও সুস্থ হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সনদ নিয়ে মানুষের দুর্ভোগও বাড়বে।

করণীয়

পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যা নিরসনেরও আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, ভোলায় একটি পিসিআর যন্ত্র বসানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানে জনবল সমস্যা আছে। তা পূরণের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন নতুন জায়গায় যন্ত্র বসানোর পাশাপাশি রি–এজেন্ট ও কিট সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। লোক নিয়োগের পাশাপাশি তাঁদের প্রশিক্ষণও দিতে হবে। এই কাজগুলো অব্যাহত আছে।

অনেকে বলছেন, সবার পরীক্ষার দরকার নেই। উপসর্গ দেখে করোনা চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে। তবে এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় এখনো হয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, পরীক্ষা বাড়ানো দরকার। দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের যেসব নতুন প্রযুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আগ্রহ থাকা দরকার। যা আছে, তাই নিয়ে বসে থাকার সময় এটি নয়।