একাত্তরের জুলাই মাসের শেষ দিকের কথা। পঞ্চগড়ের পাথরঠাকুর উচ্চবিদ্যালয় এলাকায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই চলছে। তুমুল সেই লড়াইয়ে ইপিআরের এক সিপাহি সেদিন বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। তাঁর নাম হামিদুল ইসলাম। শত্রুর কাছ থেকে মেশিনগান ছিনিয়ে নিতে গিয়েছিলেন। তখন শত্রুর গুলিতে শহীদ হন হামিদুল। এত বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের পরও হামিদুলকে কোনো উপাধি দেওয়া হয়নি বলে আফসোস করলেন তাঁরই সহযোদ্ধা মোশারেফ হোসেন। হামিদুলের আত্মত্যাগ আজও নাড়া দেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারেফ হোসেনকে।
যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে মোশারেফ বললেন, তখন তিনি পঞ্চগড় ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে কর্মরত। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে ঢাকার পিলখানা থেকে ওয়্যারলেসে একটি বার্তা আসে। সে বার্তায় জানা যায়, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ঘিরে ফেলেছে। বার্তাটি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। ইপিআর কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানি-বাঙালিদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। দুই পাকিস্তানিকে খতম করলেন তাঁরা। এরপর পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন দীর্ঘ ৯ মাস। এর মধ্যে সহযোদ্ধা অনেককেই হারিয়েছেন মোশারেফ।
গত রোববার কথা হয় মোশারেফ হোসেনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর গ্রামে। তাঁর বয়স এখন ৭৪। মুছাপুর উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণের শহীদ মিনারে বসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করেন এই বীর যোদ্ধা। ইপিআরের ওয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন তিনি।
২৭ মার্চ পঞ্চগড় থেকে তাঁরা ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হন। ৩০ মার্চ ঠাকুরগাঁও থেকে সৈয়দপুর আসেন। সেখানে ইপিআরের চারটি কোম্পানি পৃথক চারটি ভাগে ভাগ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধকালে তাঁর সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে যোগ দেন সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন। তাঁর নেতৃত্বে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত হানাদারদের বিরুদ্ধে সৈয়দপুরের আশপাশের এলাকায় যুদ্ধ করেন।
রণাঙ্গনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোশারেফ বলেন, সৈয়দপুরের দশমাইল নামক স্থানে যুদ্ধে মো. গোলজারসহ দুই সহযোদ্ধাকে হারান তাঁরা। আহত হন আবদুল মান্নান নামের আরেক সহযোদ্ধা। ৮ এপ্রিলের পর হানাদারদের কাছে তাঁরা টিকে উঠতে পারছিলেন না। তখন তাঁরা পঞ্চগড় ফিরে যান। সেখানে চার-পাঁচ দিন থাকার পর পঞ্চগড়ের ভোজনপুর গিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তখন ভোজনপুরকে ‘সাবসেক্টর ৬-বি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৯ মাস যুদ্ধের বেশির ভাগ সময় সেখানে থেকেই যুদ্ধ করেছেন মোশারেফ।
বীর এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ভারত। তখন তাঁরা পঞ্চগড়ে ছিলেন। ভারতের স্বীকৃতির পরই তাঁরা পুরো পঞ্চগড় দখল করে ফেলেন এবং পঞ্চগড় সুগার মিলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে সেটি দখলে নেন। সেই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর অনেকে নিহত হয়। ৮ ডিসেম্বর তাঁরা ঠাকুরগাঁও এবং ১০ ডিসেম্বর দিনাজপুর দখল করেন। ২৬ মার্চ থেকে বিজয় দিবস পর্যন্ত পুরো সময় তিনি যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন। যুদ্ধে সহযোদ্ধা হামিদুল ইসলাম, গোলজারসহ অনেককেই হারিয়েছেন, যাঁদের নাম এখন আর মনে নেই।
যুদ্ধ শেষে একদিনের কথা বলতে গিয়ে শিহরিত হয়ে ওঠেন মোশারেফ। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির কথা। দিনাজপুরের মহারাজা হাইস্কুলের মাঠে অসাবধানতাবশত মাইন বিস্ফোরণে বিশাল এক গর্তের সৃষ্টি হয়। আশপাশের অনেক ভবনে ফাটল দেখা দেয়। ওই বিস্ফোরণে বিদ্যালয় ভবনে থাকা প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছিলেন সেদিন। মোশারেফ সেদিন মহারাজা স্কুলের উত্তরে কৃষি কার্যালয়ের ওয়্যারলেস রুমে ছিলেন।
৯ মাস যুদ্ধ শেষে মোশারেফ হোসেন ইপিআর ও সেনাসদস্যদের নিয়ে গঠিত ১৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। পরে বিডিআর গঠিত হওয়ার পর সেখানে যোগ দেন। ২০০৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তৎকালীন বিডিআরে চাকরি করেন। সংসারজীবনে চার ছেলে, দুই মেয়ে তাঁর। বড় ছেলে সহিদুজ্জামান পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই), মেজ ছেলে মহিউদ্দিন ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তৃতীয়জন অহিদুজ্জামান সেনাবাহিনীর করপোরাল ছিলেন। ২০১৯ সালের ২০ জুলাই ফেনীতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। আর ছোট ছেলে শামছুজ্জামান আরাফাত বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক (ডিডি)। তিনি আয়রনম্যান হিসেবে পরিচিত। তিনি টেকনাফ থেকে দৌড়ে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আর দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে।
১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির কথা। দিনাজপুরের মহারাজা হাইস্কুলের মাঠে অসাবধানতাবশত মাইন বিস্ফোরণে বিশাল এক গর্তের সৃষ্টি হয়। আশপাশের অনেক ভবনে ফাটল দেখা দেয়। ওই বিস্ফোরণে বিদ্যালয় ভবনে থাকা প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছিলেন সেদিন। মোশারেফ সেদিন মহারাজা স্কুলের উত্তরে কৃষি কার্যালয়ের ওয়্যারলেস রুমে ছিলেন।
দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছেন—এটাই সবচেয়ে গর্বের উল্লেখ করে মোশারেফ হোসেন বলেন, ‘আগে আমাদের শাসন করত পশ্চিমারা। সরকারের বড় বড় পদে ছিল তাদের লোকজন। আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো না। এখন আমার দেশের মানুষ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে। আমার দেশের সন্তান সরকার চালাচ্ছে। সচিব হচ্ছে, ডিসি-এসপি হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা। স্বাধীন দেশে মুক্ত পরিবেশে বুক ফুলিয়ে চলতে পারছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নাই। আগামী দিনে এই দেশ যাতে আরও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিতে পারে, সেই প্রত্যাশা করি সব সময়।’