সৌদিতে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর পর খোঁজ নেয় না কেউ
নারী গৃহকর্মীদের সৌদি আরবগামী উড়োজাহাজে তুলে দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত তাঁরা দেশটির কোথায় এবং কী কাজে যুক্ত হন, সে বিষয়ে বাংলাদেশের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ দূতাবাসের কাছে এলে অথবা ভুক্তভোগী নারীদের স্বজনেরা কোনো অভিযোগ করলেই শুধু সরকার এ-সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারে। নারী কর্মী পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি এককভাবে সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সৌদি আরবে নারী কর্মীদের পরিস্থিতি নিয়ে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ঢাকায় একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনে
উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ১৩১ নারী। তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৯৮ জন, খুন হয়েছেন ৫ জন। তবে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, ওই চার বছরে নিহতের সংখ্যা ১৫২।
গত দুই মাসে সৌদি থেকে ফিরে আসা ১৮ নারী কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা প্রায় সবাই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের একজন মুন্সিগঞ্জের ডালিয়া বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ মাসের প্রবাসজীবনে শারীরিক-মানসিকসহ নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একদিন বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাত-পা ভেঙে দুই মাস চিকিৎসা নেন রিয়াদের একটি হাসপাতালে। এরপর বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে চার মাস সেফ হোমে (নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র) কাটিয়ে পঙ্গু হয়ে দেশে ফেরেন।
সৌদি আরবে নারী কর্মীদের সমস্যা নিয়ে ২০১৬ সালের মার্চেও রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইং ঢাকায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। এতে বলা হয়, বিদ্যমান ব্যবস্থায় সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। দূতাবাস এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অনেকটাই গৌণ। পুরোটাই একপেশে এবং সৌদি আরব আরোপিত।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বা অন্যান্য দেশের চুক্তির মতো বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তিতে গৃহকর্ম বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। ফলে গৃহকর্মী ও গৃহকর্তা (সৌদি আরবের) উভয়ের কাজ নিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির গরমিল হচ্ছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ভাষাজ্ঞান না থাকায় গৃহকর্মীরা গৃহকর্তার চড়া মেজাজ ও শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন। প্রতিবেদনে নির্যাতনের শিকার হওয়া ৪২ জন নারীর কথাও উল্লেখ ছিল, যাঁদের একজন গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
সৌদি আরবে নারী কর্মীদের কাজের বিষয়ে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কথা স্বীকার করেছেন জেদ্দা ও রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করা কূটনীতিকেরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সৌদি শ্রম প্রতিমন্ত্রী আবদুল মজিদ আল রাশুদির সঙ্গে আলোচনা করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ। সৌদি আরবে পৌঁছার পর নারী কর্মীদের নির্ধারিত কাজের জায়গা থেকে অন্য গন্তব্যে পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে। এতে তাঁদের সম্পর্কে দূতাবাস কিছু জানতে পারে না। এ বিষয়গুলো যাতে না ঘটে, সে জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে সৌদি প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান রাষ্ট্রদূত।
নারী কর্মীদের সমস্যার বিষয়ে রিয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেখুন, আজ (শনিবার) দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে ১৪ বছরের কিশোরীকে আনা হয়েছে। প্রায় তিন মাস আগে এখানে এসে সে বৈরী পরিস্থিতিতে পড়ে। এখন বলুন, এই বয়সের একটি কিশোরীকে কীভাবে পাঠানো হলো? কে পাঠাল? এগুলোর তো সুরাহা হওয়া উচিত। সম্প্রতি দূতাবাস এক বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে ৫০ জন নারী কর্মীর ওপর সমীক্ষা চালায়। এতে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে নয়জন সৌদি আরবে এসেছেন কোনো রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই। অথচ এঁদের সবার স্বাস্থ্যসনদ আছে।’
নারী কর্মীদের সমস্যা নিয়ে ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দেশের যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক হবে বলে জানান গোলাম মসিহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, তা সুরাহার অনুরোধ জানানো হবে; পাশাপাশি আমরা বেতন বাড়াতে বলব।’
দূতাবাস সূত্র জানায়, নেপাল ১ হাজার ৬০০ রিয়াল (সৌদি মুদ্রা) বেতনের নিচে কোনো নারী কর্মী পাঠাচ্ছে না। আর ফিলিপাইন ১ হাজার ৮০০ বা ২ হাজার রিয়াল ছাড়া কোনো কর্মীকে সৌদি আরবে পাঠায় না। অথচ বাংলাদেশের নারী কর্মীরা পান মাত্র ৮০০ রিয়াল (১৭ হাজার ৬০০ টাকা)।
সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করার দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদেও। ১২ নভেম্বর সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে তিনজন সাংসদ এই দাবি জানান। সেদিন সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘মা-বোনদের আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাঁরা ওইখান থেকে যৌন নির্যাতনসহ নানা রকম অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হয়ে অবশেষে লাশ হয়ে ফিরে আসেন। মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নেয় না।’
নারী গৃহকর্মী পাঠাতে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই হয়। এরপর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮৮ নারী সৌদি আরবে গেছেন। এই তথ্য সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম মাসে দেশটি থেকে সরকারের মধ্যস্থতায় ফেরত এসেছেন ৮ হাজার ৬৩৭ জন। দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, এর বাইরে আরও প্রায় দেড় হাজার নারী গৃহকর্মী গত ১০ মাসে নানাভাবে দেশে ফিরেছেন।
সৌদি আরবে নারী কর্মীদের সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নারী কর্মীরা যেসব অভিযোগ করছেন, সৌদি চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে ডেকে তা জানিয়েছি। পাশাপাশি রিয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে এই অভিযোগগুলো নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি।’
অবশ্য নারী গৃহকর্মী পাঠানোর শুরু থেকেই সৌদি আরব বলে এসেছে, কাজ করার মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে সামর্থ্য থাকার পাশাপাশি আরবি ভাষা, সেখানকার রীতিনীতি ও জীবনাচার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকতে হবে। এ বিষয়গুলোতে কখনো জোর দেওয়া হয়নি। প্রশিক্ষণের নামে যেনতেনভাবে নারীদের পাঠানো হচ্ছে।
সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর নিবন্ধন রয়েছে প্রায় ৭০০ রিক্রুটিং এজেন্সির (জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান)। অভিযোগ আছে, কিছু এজেন্সি নিয়ম না মেনে দালালদের মাধ্যমে নারীদের সৌদি আরবে পাঠায়। পাঠানোর আগে তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে না।
যেসব এজেন্সির মাধ্যমে গিয়ে নারীরা সংকটে পড়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাধারণ সম্পাদক নোমান আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটাই সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে। নারী কর্মীরা যেসব সমস্যার কথা তুলছেন, তার সুরাহা হওয়া উচিত। সরকার, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও সৌদি কর্তৃপক্ষ মিলেই কাজটি করা উচিত।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ১২ নভেম্বর সংসদে বলেছিলেন, বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ১৬০টি এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত, তিনটি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
শুরু থেকেই ধর্ষণ, নির্যাতন ও মারধরের অভিযোগ করে আসছেন নারী কর্মীরা। এসব অভিযোগের বিষয়ে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী না হওয়ায় সমস্যা দিনে দিনে জটিল হয়েছে বলে মনে করেন অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, সৌদি পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় নারী কর্মীরা সমস্যায় পড়ছেন।
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনীম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন পরপর নারী কর্মীদের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে অভিবাসনের কঠিন চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে। নির্যাতিত হয়ে যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়ে অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিকে চিহ্নিত করে কালো তালিকাভুক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দৃষ্টান্ত সৃষ্টির জন্য দূতাবাস নির্যাতিত দু-একজনের পক্ষে সৌদি আরবে আইনি লড়াই করার উদ্যোগ নিতে পারে। এতে নির্যাতিত কর্মীরা সুবিচার পাওয়ার জন্য সৌদি আরবের আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
আরও পড়ুন:
তাঁরা শুধুই একেকটি সংখ্যা