সৈয়দপুর বিমানবন্দরে আত্মসমর্পণ

একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন সৈয়দপুরের কাহিনি

.
.

‘ওদের পরনে শুধু খাকি পোশাকটাই ছিল। কোনো র্যাঙ্ক ব্যাজ ছিল না, কোমরে ছিল না বেল্ট। এমনকি পায়ে ছিল না ভারী বুট। বিমর্ষ দেখাচ্ছিল হানাদারদের। অথচ দুদিন আগেও ওদের বদমেজাজি হিংস্র চেহারা ছিল, কথায় কথায় বাঙালিদের বুকে গুলি চালাত।’ বলছিলেন মির্জা আকতারুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধে নীলফামারীর সৈয়দপুর সেনানিবাসে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনটির কথা স্মরণ করছিলেন তিনি। ওই সেনানিবাসে তিনি বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে টানা আট মাস সেনানিবাসেই কাটাতে হয়েছে মির্জা আকতারকে। ফলে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নিপীড়ন, শেষে তাদের পরাজয় এবং অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ—সবই তিনি দেখেছেন কাছ থেকে।
১৬ ডিসেম্বর রাতে চিলাহাটি সীমান্ত দিয়ে মিত্রবাহিনীর বিশাল কনভয় সৈয়দপুর সেনানিবাসে ঢুকে পড়ে। ছিল জিপ, ট্রাক, ট্যাংক মিলিয়ে শ খানেক যানবাহন। নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জোশি। সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈনিকেরা। সেনানিবাসে রাতভর মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়: ‘হাতিয়ার ডাল দো’, অর্থাৎ অস্ত্র ফেলে দাও।
মিত্র বাহিনীর পিছু পিছু মির্জা আকতারও সৈয়দপুর সেনানিবাস এলাকার পশ্চিম পাশে নির্মাণাধীন বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। রাত প্রায় ১২টা। সেখানে তখন পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, দিনাজপুর থেকে আসা কমপক্ষে পাঁচ হাজার পাকিস্তানি সেনা অপেক্ষা করছিল।

সৈয়দপুর অফিসার্স কলোনিতে নির্মাণাধীন স্মৃতিস্তম্ভের সামনে মির্জা আকতারুল ইসলাম (বাঁয়ে) ও মুক্তিযোদ্ধা জিকরুল হক l ছবি: এম আর আলম

সৈয়দপুর বিমানবন্দরেই আত্মসমর্পণ দৃশ্যের মঞ্চায়ন পাকিস্তানিদের জন্য এক নিষ্ঠুর পরিহাস বটে। কেন, সেটা ব্যাখ্যা করেন লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ এ জহীর, বীর প্রতীক। পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট সেনানিবাস থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তখনকার এই তরুণ লেফটেন্যান্ট। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি রানওয়ে আগে থেকেই ছিল সৈয়দপুরে।

যুদ্ধের সময় সেটাকে সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে পাকিস্তানিরা। উদ্দেশ্য সৈয়দপুরে ভারী অস্ত্রশস্ত্র আনানো ও বড় আকারের বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ করানো। আর এ কাজে অবরুদ্ধ বাঙালি ও গ্রামের যুবক-বৃদ্ধদের ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করা হয়। তাদের পিঠে চাবুক মেরে দ্রুত কাজ করতে বাধ্য করা হতো। কেউ অক্ষম হলে তাকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হতো বিমানবন্দরেই। এভাবে সাড়ে পাঁচ মাসে যে বিমানবন্দর তৈরি হয়, তার নাম দেওয়া হয় জমজম এয়ারপোর্ট। ‘দেশের মানুষদের অত্যাচার ও হত্যা করে যে বিমানবন্দর তারা নির্মাণ করেছিল, সেই স্থানেই নরঘাতকদের নির্লজ্জভাবে অস্ত্র সমর্পণ করতে হয়েছিল।’ বললেন সাজ্জাদ এ জহীর, বীর প্রতীক।
আত্মসমর্পণের দৃশ্যের বিবরণ পাওয়া যায় মিত্রবাহিনীর লে. কর্নেল দলজিৎ সিংয়ের লেখায়। ঢাকা থেকে একটি হেলিকপ্টারে সেখানে উড়ে আসেন তিনি। নেমে স্যালুট করেন সৈয়দপুর সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম শফিকে। করমর্দনের পর দলজিৎ সিং বলেন, ‘ভালো হতো এর চেয়ে আনন্দদায়ক কোনো পরিস্থিতিতে যদি আমাদের মোলাকাত ঘটত।’ ব্রিগেডিয়ার শফি মৃদু কণ্ঠে জবাব দেন, ‘একেই বলে যুদ্ধের কপাল। আমি মাত্র পাঁচ দিন আগে এখানকার দায়িত্ব নিয়েছি।’
দলজিৎ সিংয়ের হিসাবে ১৭ তারিখ বিকেল সাড়ে চারটায় সৈয়দপুর বিমানবন্দরে আত্মসমর্পণ করে প্রায় পাঁচ হাজার পাকিস্তানি সেনা। এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৮ জন অফিসার আর ১১৪ জন জেসিও। দিল্লির নির্দেশে এই দৃশ্যের কোনো ছবি ধারণ করা হয়নি বলে আফসোস করেছেন দলজিৎ সিং।

আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের অনেককে কাঁদতে দেখেছেন মির্জা আকতার। দলজিৎ সিংয়ের লেখাতেও কান্নাকাটির বিবরণ পাওয়া যায়। স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, দিনাজপুরের ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরেশি টানা কাঁদছিলেন। অশ্রুর ধারা তাঁর পাকানো গোঁফে এসে শুকিয়ে গেছে। তাঁর গলাও ধরে আসা। দলজিৎ সিং লিখেছেন, ‘এভাবে পূর্ণবয়স্ক লোকজনকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখা সত্যি হৃদয়বিদারক।’