করোনার বিষয়ে এখন লক্ষণ দেখেই সুস্থতার ছাড়পত্র
করোনা রোগীর সুস্থতার সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেতে রোগীকে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, হাসপাতাল ছাড়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
আগে ২৪ ঘণ্টায় পরপর দুটি পরীক্ষায় শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত না হলে রোগীকে সুস্থ বলা হতো এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হতো। এখন বলা হচ্ছে, এই পরীক্ষার দরকারই নেই। লক্ষণ দেখে রোগীকে সুস্থ বলে ছাড়পত্র দেওয়া যাবে। গতকাল শুক্রবার নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা এই নতুন চিকিৎসাবিধির (ট্রিটমেন্ট প্রটোকল) কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। তিনি বলেন, করোনাবিষয়ক কারিগরি কমিটি এটা ঠিক করেছে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) মো. আমিনুল হাসানের সই করা একটি চিঠি করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ৫ মে সই করা ওই চিঠিতে রোগীকে ছাড়পত্র দিতে পাঁচটি মাপকাঠির কথা বলা আছে: প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ ছাড়াই জ্বর কমে গেলে, কাশি বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলে এবং ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর দুটি আরটি–পিসিআর পরীক্ষার ফলাফল ঋণাত্মক হলে রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া যাবে। তবে কোনো কারণে পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে পরপর তিন দিন অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা প্রথম দুটি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে রোগী ছাড়া পাবে। এ ছাড়া রোগীকে বাড়িতে বা সরকার নির্ধারিত স্থানে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে এবং সম্ভব হলে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালে সব রোগীর দুবার পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই নতুন পথে গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) কোভিড–১৯–বিষয়ক নির্দেশিকার সহায়তা নিয়েছে, সমর্থন নিয়েছে। সিডিসি বলছে, পরীক্ষা না করেও লক্ষণ দেখে রোগীকে সুস্থ বলা যাবে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো তাদের অবস্থান বদলায়নি। তারা বলেছে, ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি পরীক্ষায় রোগীর শরীরে ভাইরাস শনাক্ত না হলে রোগীকে সুস্থ বলা যাবে।
>আগে ২৪ ঘণ্টায় দুটি পরীক্ষায় করোনা ভাইরাস শনাক্ত না হলে রোগীকে সুস্থ বলা হতো
এখন লক্ষণ দেখে সুস্থতার ছাড়পত্র
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এম এ ফয়েজ বলেন, ‘হাসপাতাল ছেড়ে রোগীকে বাড়িতে গিয়ে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে। মাস্ক পরাসহ আইসোলেশনের সব নিয়ম মানতে হবে।’ অধ্যাপক ফয়েজ করোনা বিষয়ে জাতীয় কারিগরি কমিটিরও সদস্য।
সুস্থতার হার বাড়ল
গতকাল বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ১৯১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ পর্যন্ত মোট বাড়ি ফেরার সংখ্যা ২ হাজার ১০১। সুস্থ হওয়ার সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায় ৪ মে থেকে। ওই দিন ৮৮৬ জন সুস্থ হওয়ার ঘোষণা আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। অথচ ৮ মার্চ প্রথম রোগী ভর্তি হওয়ার পর থেকে ৪ মে পর্যন্ত ৫৬ দিনে সুস্থ হয়েছিলেন ১৭৭ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে সুস্থ হওয়ার সংখ্যা ছিল তিনজনের মতো।
২০ এপ্রিল রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি ভাইরাসমুক্ত হয়েছেন কি না, তা জানতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) স্বাস্থ্যকর্মীরা ২৫ এপ্রিল তাঁর নমুনা সংগ্রহ করেন। পরীক্ষার ফলাফল জানায়নি এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় নমুনাও নেয়নি। তবে আইইডিসিআর দ্বিতীয় নমুনা নেয় ১ মে এবং রাতে ফলাফল জানায়। কিন্তু রোগী জানতেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুবার পরীক্ষার ফল ঋণাত্মক হলেই তিনি সুস্থ বলে বিবেচিত হবেন।
২ মে ওই রোগীকে ছেড়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ছাড়পত্র দেওয়ার আগে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, দুটো পরীক্ষার দরকার নেই। পর পর তিনদিন জ্বর নেই বলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ওই রোগী ও রোগীর আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক গোলাম নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘লক্ষণ দেখে সুস্থতার কথা বলা যায়, কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া ভাইরাসমুক্ত এ কথা বলা সম্ভব না। তাই কিছু রোগীর পরীক্ষা আমরা করব, এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তিনি বলেন, যাঁরা ভাড়াটে তাঁদের অনেকের ভাইরাসমুক্ত এমন সনদ দরকার হবে। এ ছাড়া যাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন (স্টিগ্মাটাইজড) তাঁদের অনেকের জন্যই এটা দরকার। সব মিলে ৪০ শতাংশ রোগীর জন্য সনদ দরকার হবে বলে তাঁর ধারণা।
আগে কী ছিল, এখন কী
হাসপাতালে রোগী ভর্তির প্রথম খবর পাওয়া যায় ৮ মার্চ। এরপর থেকে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রেস ব্রিফিংয়ে বারবার বলেছেন, কোনো রোগী সুস্থ বলে বিবেচিত হতে হলে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি পরীক্ষার ফল ঋণাত্মক হতে হবে।
একজন করোনা রোগীর ছাড়ের মাপকাঠির বর্ণনা করা আছে করোনা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশনায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার তৈরি করা ওই নির্দেশিকায়, রোগী ছাড়ের ব্যাপারে সাতটি মাপকাঠি আছে। এর অন্যতম হচ্ছে ২৪ ঘণ্টায় দুটি পরীক্ষা করা।
এই নির্দেশিকা তৈরি হয়েছিল মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৩ মার্চ তৈরি করা নির্দেশিকা অনুসরণ করে। ততে বলা ছিল, হাসপাতালের রোগীর পরীক্ষা হবে একটি দেশের রোগতাত্ত্বিক পরিস্থিতি ও সম্পদের পর্যাপ্ততার ওপর। হাসপাতাল থেকে রোগীর ছাড়পত্র দেওয়ার আগে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটো পরীক্ষা আরটি–পিসিআর পরীক্ষা করতে হবে। দুটো পরীক্ষার ফলাফল ঋণাত্মক হলেই কেবল রোগীকে ছাড় দেওয়া যাবে। গতকাল পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি।
কারিগরি কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশে মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির নির্দেশনা আমরা এখন মেনে চলার ব্যাপারে একমত হয়েছি।’ সিডিসির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ৩০ এপ্রিল তারা সংশোধিত নির্দেশনা প্রকাশ করেছে।
কী করণীয়
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো একটি সংজ্ঞা ব্যবহার করছে। এটা পরিষ্কার করা দরকার যে এই সংজ্ঞা অনুসারে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মানেই ওই ব্যক্তি করোনাভাইরাসমুক্ত নন। তাঁকে ১৪ দিনের আইসোলেশনের বিষয়টি মানতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, আইসোলেশন হতে পারে নিজের বাড়ি বা সরকার নির্ধারিত স্থান। আইসোলেশনে অবশ্যই প্রত্যেককে মাস্ক পরতে হবে।