সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য অনন্য উদ্যোগ

সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে শিশুরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন এলাকায়।  প্রথম আলো
সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে শিশুরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন এলাকায়। প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশন–সংলগ্ন বস্তিতে মায়ের সঙ্গে থাকে শিশু জান্নাতুল ফেরদৌস। বাবা থেকেও নেই। দুই বছর ধরে তাদের খোঁজ নেন না, বাড়িও আসেন না। মা রোবেয়া আক্তার এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে সংসার চালান। টানাটানির কারণে গত বছরের শেষ দিকে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় হাটহাজারীর কুলালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ছাত্রীর। অথচ জান্নাতুল পড়ালেখায় বেশ ভালো। পড়া বন্ধ হওয়ার আগে তৃতীয় শ্রেণিতে তার ক্রমিক নম্বর ছিল ৫। তবে এখন আবার স্কুলে ফিরে গেছে সে। ভর্তি হয়েছে চতুর্থ শ্রেণিতে। স্কুলের বেতন, খাতা, কলম, স্কুলব্যাগ সবই মিলছে বিনা মূল্যে।

সুবিধাবঞ্চিত জান্নাতুলের এভাবে স্কুলে ফিরে আসার পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত ১০০ ঝরে পড়া শিশুকে তাঁরা আবার স্কুলে ফিরিয়ে এনেছেন। শিশুদের লেখাপড়ার খরচ, শিক্ষার সরঞ্জাম সবই সরবরাহ করছেন ওই শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয় আরও শ চারেক শিশুকে বিনা মূল্যে খাতা, কলম ও স্কুলব্যাগ দিচ্ছেন তাঁরা। পাশাপাশি প্রত্যেক শিশুকে পাঠদানও করছেন নিয়মিত।

এ জন্য খুব বেশি অর্থের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন পড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ওই তরুণদের। সদিচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন কেবল এক টাকার সাহায্য নিয়ে। দিনে এক টাকা এমন সদিচ্ছার জন্য জমা রাখতেন তাঁরা। এরপর সবাই মিলে গঠন করলেন ‘এক টাকায় শিক্ষা’ নামের একটি সংগঠন।

২০১৭ সালের মার্চের দিকের কথা। এক দুপুরে বন্ধুদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের (বর্তমানে দ্বিতীয় বর্ষ) শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিজুয়ান। এমন সময় একটি শিশু এল একটি পত্রিকা কেনার আবদার নিয়ে। সেই শিশুর সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জানতে পারেন, পড়ালেখার ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে সে পারছে না। বিষয়টি দাগ কেটে যায় রিজুয়ানের মনে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু করার। বন্ধুদের খুলে বলেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। সেখান থেকেই শুরু—‘এক টাকায় শিক্ষা’ নামের সংগঠনটির।

প্রথমে তাঁরা প্রতিদিন এক টাকা হিসাবে মাসে ৩০ টাকা করে জমা দিতেন। কয়েক মাস টাকা জমার পর ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে পড়ানো শুরু করেন পাশের বস্তির ১৫ সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে। এই শিশুদের স্কুলে ভর্তি, বেতন থেকে শুরু করে, ব্যাগ-বইসহ শিক্ষার সব আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে দেন তাঁরা।

স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা

শুরুটা ছিল ২২ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টা। তাঁদের টাকায় ষোলশহরের রেলওয়ে বস্তির ১৫ সুবিধাবঞ্চিত ঝরে পড়া শিশু বিদ্যালয়ে ফিরে যায়। বিষয়টি আরও অনেকের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন সংগঠনের সদস্যরা। তাতেও সফল হলেন তাঁরা।

কীভাবে? রিজুয়ানের মুখ থেকেই শোনা যাক সে কথা—‘আমাদের লক্ষ্য হলো চট্টগ্রাম জেলার সব সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ২২ জনের টাকার মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জন কখনো সম্ভব নয়। তাই আমরা চেষ্টা করেছি আরও অনেকের মাঝে এটি ছড়িয়ে দিতে। ফেসবুকে “এক টাকায় শিক্ষা” নামে একটি গ্রুপ খুলে সবাইকে জানাই পরিকল্পনার কথা। যাঁরা আগ্রহ দেখান তাঁদের আমরা সদস্য করি। বর্তমানে যুক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩০০ জন। তাঁদের প্রায় ৭০০ জন দিনে এক টাকা হিসাবে প্রতি মাসে টাকা জমা দেন। টাকা জমার হিসাব সবাইকে জানাতে চালু করেছি একটি ওয়েবসাইট।’

৫০০ জনের পাশে

২২ জন নিয়ে শুরু হওয়া এ সংগঠনের সঙ্গে আরও অনেকেই যোগ দেওয়ায় চলতি বছরের শুরুতে ষোলশহরের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনের পাশের বস্তিতেও দুটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়। স্টেশন লাগোয়া বস্তিতে বেড়ে ওঠা প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া ৮৫ জনকে সপ্তাহের চার দিন পড়ানো হচ্ছে সেখানে। সব মিলিয়ে বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক শ জনে। এ ছাড়া আগস্ট থেকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে সংগঠনটি। কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত চারটি বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসার চার শ সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীকে শিক্ষা সরঞ্জাম দিয়েছেন তাঁরা।

সরেজমিন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনের বস্তি–সংলগ্ন ছোট্ট একটা বেড়ার ঘর। তার ভেতরে মনের আনন্দে পড়ছে-লিখছে ৩০ শিশু। তারা প্রাক–প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২৫ অক্টোবর সেখানে কথা হয় হাটহাজারীর কুলালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুলের সঙ্গে। ছোট্ট জান্নাতুল বলে, ‘ভার্সিটির এই ভাইয়া ও আপুরা না থাকলে আমার পড়া হতো না। তারাই মাকে বলে আমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। এখানে বিকেলে এসে ভাইয়াদের কাছ থেকে পড়াও বুঝে নিই।’

জান্নাতুলের মা রোবেয়া আক্তারও মেয়ের সঙ্গে এসেছিলেন সেখানে। তিনি বলেন, ‘কাজ করে যা উপার্জন করি তা বাসা ভাড়া ও খাওয়ার খরচেই চলে যায়। সে জন্য মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম বাধ্য হয়ে। এখন ছাত্ররা মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. হানিফ সিদ্দিকী শুরু থেকেই এই উদ্যোগের সঙ্গে আছেন। ‘এক টাকায় শিক্ষায়’ সংগঠনকে তিনি আর্থিক সহায়তা ও নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, এখনকার তরুণেরা ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল জগতে ব্যস্ত। এই অতিকেন্দ্রিকতা ছেড়ে কয়েকজন তরুণ যে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। এটা অন্যদের সামনে দৃষ্টান্তও।