সুবিধা পেয়ে ক্ষোভ কমল তাঁদের
সংসদীয় কমিটির প্রধান কাজ কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা। সে জায়গায় থেকে নিজেরাই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজের অংশীদার হতে চাইছে ধর্ম মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংসদীয় কমিটি নিজেই যদি মন্ত্রণালয়ের কাজে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, তাহলে তদারকি ও জবাবদিহি করবে কে? এটা আইনানুগ নয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা পবিত্র হজ, চাঁদ দেখা, মন্দির-শ্মশান সংস্কারের মতো মন্ত্রণালয়ের কাজগুলোয় নিজেদের সম্পৃক্ততা চান। এসব কাজে সম্পৃক্ততা না থাকায় কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন একাধিক সদস্য। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁরা কিছু সুবিধা পেয়েছেন। ফলে, তাঁদের ক্ষোভও কমেছে।
গত ১০ জুন জাতীয় সংসদ ভবনে ধর্ম মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে সদস্যদের ক্ষোভ, হতাশা ও দাবিদাওয়ার কথা জানা যায়। সেদিনের বৈঠকে কমিটির সভাপতি রুহুল আমীন মাদানী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করে ১০ সদস্যের স্থায়ী কমিটি গঠন করেছেন। অথচ এই কমিটি কোনো কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে পারছে না। তিনি বলেন, স্থায়ী কমিটির সদস্যরা হজের কাজে কোনো ভূমিকা রাখতে না পারায় তাঁরা জনগণের কাছে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন।
একই বৈঠকে কমিটির সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী বলেন, এবার হজসংক্রান্ত বিষয়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্য নেই। কমিটির আরেক সদস্য রত্না আহমেদ বলেন, স্থায়ী কমিটির কী কাজ, সে বিষয়ে তিনি জানেন না। তিনি বলেন, নাটোরে রমজান মাসে ইমাম সম্মেলন নিয়ে কয়েকটি অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু তাঁকে সেখানে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। এতে তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে। তিনি বলেন, একটি নতুন স্বপ্ন নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির কাজ শুরু করেছিলেন। প্রথম বৈঠকে নতুনভাবে কাজ করে চমক দেখানোর আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
কমিটির আরেক সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বলেন, কোথায় মন্দির ও শ্মশান নির্মাণ করা হবে, তা সংসদীয় কমিটির সদস্যদের অবহিত করা হয় না। কমিটির আরেক সদস্য শওকত হাচানুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে মনোনয়ন দিয়েছেন। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনেক কার্যক্রম হচ্ছে অথচ কোনো কার্যক্রমে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। এমনকি সাংসদদের অবহিতও করা হয়নি। হজ কার্যক্রম ও চাঁদ দেখা কমিটিতে সম্পৃক্ত করা হয়নি। কিন্তু স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
কমিটির আরেক সদস্য তাহমিনা বেগম বলেন, হজের বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের যথাযথ গুরুত্ব থাকা সমীচীন। সব বিষয় জানাতে না পারলেও কিছু কিছু বিষয় জানালেও তাঁরা সম্মানিত হতেন।
মনোরঞ্জন শীল গোপাল বলেন, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কাছে জনগণের কিছু প্রত্যাশা আছে। তাই তিনি মন্দির, শ্মশান সংস্কার তালিকা করার কাজে সংসদীয় কমিটির সদস্যদের সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব করেন।
দ্বিতীয় বৈঠকে এমন বক্তব্যের পর কিছু সুবিধা পেয়েছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। সংসদীয় কমিটির সভাপতি রুহুল আমীন মাদানী, কমিটির সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী ও রত্না আহমেদকে ১০ সদস্যের হজ প্রতিনিধিদলে রাখা হয়েছে। তাঁরা হজের কাজ তত্ত্বাবধানে সৌদি আরব যাবেন। এ ছাড়া কমিটির নয়জন সদস্যের প্রত্যেকে পাঁচজন করে প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রীয় খরচে হজে পাঠানোর সুযোগ পেয়েছেন। কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে। গত মঙ্গলবার কমিটির তৃতীয় বৈঠকে ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়টি কমিটিকে জানিয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয় বলেছে, ভবিষ্যতে প্রকল্প প্রণয়নে মন্দির, শ্মশান, আশ্রম তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে সাংসদদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রুহুল আমীন মাদানী প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রতি তাঁদের কোনো ক্ষোভ নেই, আগেও ক্ষোভ ছিল না। তাঁরা মন্ত্রণালয়ের কাজে সম্পৃক্তও হতে চান না। তবে মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সদস্যরা প্রায় সবাই নতুন। এ কারণে সবার কিছু দাবিদাওয়া থাকে। কমিটির সদস্যরা তাঁদের এলাকার কয়েকজনকে সরকারি খরচে হজে পাঠানোর সুযোগ দেওয়ার দাবি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে ধর্মমন্ত্রী তা গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া চাঁদ দেখা কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের রাখার দাবি জানিয়েছিলেন কেউ কেউ।
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাজ হলো সংসদ থেকে পাঠানো যেকোনো বিল বা বিষয় পরীক্ষা করা, কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলি পর্যালোচনা করা, মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ বা অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা এবং কমিটি যথোপযুক্ত মনে করলে কমিটির আওতাধীন যেকোনো বিষয় সম্পর্কে পরীক্ষা করা ও সুপারিশ করা।
কমিটির সদস্যরা মন্ত্রণালয়ের কাজের সুবিধাভোগী হলে তাঁদের পক্ষে কাজ করা কঠিন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সংসদ বিষয়ে গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সদস্যদের এসব দাবি অযৌক্তিক, আইনানুগ নয়। তাঁদের মূল কাজ মন্ত্রণালয়ের কাজ তদারকি করা। সংসদীয় কমিটি যদি চাঁদ দেখা কমিটিরও অংশ হয়, তাহলে জবাবদিহি করবে কে?