সাক্ষাৎকার
সুফল পেতে দরকার ‘পদ্মা-প্লাস’ উদ্যোগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ২০০৯ সালে পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে গবেষণার কাজ করেছিলেন। সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে তিনি এর আর্থসামাজিক প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: প্রায় এক যুগ আগে পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে আপনি গবেষণার কাজ করেছিলেন। তখনকার অর্থনৈতিক তাৎপর্য কি এখনো একই রকম আছে?
সেলিম রায়হান: আমরা পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে গবেষণায় বলেছিলাম, দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন থেকে শুরু করে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধির বিকাশে সেতু সহায়ক হবে। গত এক যুগে অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনৈতিক তৎপরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সেদিক থেকে তুলনা করলে এখন পদ্মা সেতুর তাৎপর্য আরও অনেক বেশি।
প্রশ্ন :
সেতুর সুফল পেতে হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম রায়হান: দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। এটি বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। আধুনিক কর্মকৌশল ব্যবহার করে কীভাবে রাস্তাঘাটসহ বন্যা-প্রতিরোধী অবকাঠামো করা যায়, সেটি মাথায় রাখতে হবে। বিনিয়োগ পরিস্থিতির বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার। রাস্তাঘাটই কিন্তু বিনিয়োগের একমাত্র অনুঘটক নয়। সহজ সুদে ঋণ, দক্ষ শ্রমিক ও জমির প্রাপ্যতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন দরকার ‘পদ্মা প্লাস’ উদ্যোগ। পদ্মা সেতু উন্নয়নের একটি বড় অনুঘটক। এটিকে কেন্দ্র করে যদি বিনিয়োগের অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে পারি, তবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ সম্ভব।
প্রশ্ন :
এর আগে যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু হয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের নিরিখে পদ্মার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতুর মিল-অমিল কোথায়?
সেলিম রায়হান: বঙ্গবন্ধু সেতুর অভিজ্ঞতা পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনায় শিক্ষণীয় হতে পারে। বঙ্গবন্ধু সেতু যখন করা হয়েছিল, তখন ‘সেতু-প্লাস’ কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সুবিধা দেওয়া বা বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নয়নের বিষয়গুলো ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধু সেতুর শুরুর বেশ কয়েক বছর কাঙ্ক্ষিত ফল আমরা দেখিনি।
প্রশ্ন :
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চল ট্রান্স–এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স–এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে। অঞ্চলটির শিল্প–বাণিজ্যিক খাতে নতুন উদ্যোগ কী হতে পারে?
সেলিম রায়হান: অনেক কারণে দক্ষিণে শিল্প গড়ে ওঠেনি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একটা বড় সমস্যা ছিল। দক্ষিণের মৎস্য খাত, কৃষিজাত পণ্য, পাটশিল্প, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, লবণাক্ত–সহিষ্ণু ধান এবং অন্যান্য শস্য—এগুলোর প্রসারের বিষয়টি ভাবতে হবে। পাশাপাশি বন্যা-প্রতিরোধী অবকাঠামোর মাধ্যমে ভূমির উন্নয়ন করে অর্থনৈতিক এলাকা করা গেলে আমাদের অর্থনীতির মূলধারার খাতের শিল্পমালিকেরা এ অঞ্চলে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে। এ অঞ্চলের মানুষের কাজের বন্দোবস্ত হবে।
প্রশ্ন :
পদ্মা সেতুতে রেলপথ সংযোজন কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
সেলিম রায়হান: পদ্মা সেতুতে রেল সংযুক্ত করা সাহসী পদক্ষেপ। পায়রা বা মোংলা বন্দর, বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে পণ্য পরিবহন শুধু স্থলপথে কুলাবে না। সে ক্ষেত্রে রেলপথ দরকার। কিন্তু আমাদের বড় প্রকল্পগুলোর বড় সমস্যা হলো, ‘কস্ট ওভার রান’ ও ‘টাইম ওভার রান’। এত বড় প্রকল্পের সুফল পেতে হলে সাশ্রয়ী খরচে সময়মতো কাজ শেষ করতে হবে।
প্রশ্ন :
সেতু হওয়ায় পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের আরও কার্যকর ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বন্দর দুটি কতটুকু প্রস্তুত?
সেলিম রায়হান: দুটি বন্দরে এবং বিভিন্ন নতুন অবকাঠামোর উন্নয়নের গতি দ্রুত হলে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল পাব। আপনি ট্রান্স–এশিয়ান রেল ও হাইওয়েতে কানেক্টিভিটির কথা বলেছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো, নেপাল, ভুটানের জন্য একটি উপ-আঞ্চলিক সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। ভৌগোলিকভাবে এই পুরো অঞ্চলে বাংলাদেশ একেবারে কেন্দ্রে। বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি নীতির উন্নয়ন ও সহায়ক নীতিগুলো সামনে আনতে পারলে এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিতে পারে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সেতু হওয়ার আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিজমিতে শিল্প স্থাপনের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণাঞ্চল ঝুঁকিতে আছে। এ অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম রায়হান: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে এ অঞ্চল ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বাড়ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগও এ অঞ্চলে বেশি ঘটে। কৃষিজমি শিল্পে কতটুকু ব্যবহার করা যাবে, তার নিয়ম আছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পের জন্য জমির বরাদ্দ দিলে কৃষিজমি যেমন বাঁচবে, তেমনি বিনিয়োগকারীরাও এক জায়গায় সব সুবিধা পাবেন।