সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরছে। বর্তমান সরকারের সময়ে এই ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে দিতে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দিতে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে।
মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারকদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধি প্রণয়ন করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। এগুলো অনুসরণ না করা হলে তা গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।
রায়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ উপ-অনুচ্ছেদ পুনবর্হাল করা হয়। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে এসেছে। এই কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতিকে নিয়ে।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর বৈধতা নিয়ে করা রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গত ৩ জুলাই সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে দেন। এর চার সপ্তাহের মাথায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গতকাল পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলো।
মূল রায়টি লিখেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যায়, একজন ছাড়া সব বিচারপতি পৃথকভাবে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। বলা হয়েছে, সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করা হলো, হাইকোর্টের কিছু মন্তব্য বাতিল করা হলো।
রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘রায়ে সর্বসম্মতিক্রমে আপিল খারিজ করে সংবিধানের ৯৬-এর (২) থেকে (৭) পর্যন্ত পুনর্বহাল করা হয়েছে। আমার বিবেচনায় সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ সংশোধন করা বা বাদ দেওয়া সবটাই সংসদের ব্যাপার ও এখতিয়ার। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা হয়েছিল, সেটি আবার পুনর্বহাল করা হয়েছে। রায়ে বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে, এর সঙ্গেও সব বিচারপতি একমত পোষণ করেছেন।’ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করা হবে কি না, এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, রিভিউয়ের বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
৩৯ দফার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ
রায়ে বলা হয়, সন্দেহ ও বিভ্রান্তি এড়াতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি আচরণবিধি পুনরায় প্রণয়ন করা হচ্ছে। এতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি যদি কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো সূত্রে কোনো বিচারকের আচরণের বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ করেন তাহলে প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের পরবর্তী দুই জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে তদন্ত করবেন। কোনো অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারক অস্বীকৃতি জানালে কিংবা অভিযোগ যদি তাঁদের বিরুদ্ধেই উঠে থাকে তাহলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারক ওই কমিটির সদস্য হবেন। এরপর তদন্তে যদি প্রাথমিকভাবে দেখা যায় অভিযোগের প্রাথমিক ভিত্তি রয়েছে, তখন প্রধান বিচারপতি বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন। কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে তা দ্রুত এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। তবে বিচারক যদি ভিন্নরূপ কোনো অনুরোধ না করেন, তাহলে বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করার বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে গোপন রাখা হবে। সব ধরনের শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় মানদণ্ডে সম্পন্ন করা হবে।
একজন বিচারক উচ্চ মানের আচার প্রতিষ্ঠা, প্রয়োগ ও রক্ষণে অংশ নেবেন এবং ব্যক্তিগতভাবে এই মান মেনে চলবেন, যাতে বিচার বিভাগের ন্যায়পরায়ণতা এবং স্বাধীনতা বজায় থাকে। একজন বিচারককে সংবিধান ও আইন মানতে হবে। সব সময় এমন কাজ করবেন, যাতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ে। পরিবার, সামাজিক গণ্ডি বা অন্য কোনো সম্পর্কের কাউকে রায় বা বিচারিক আচরণ প্রভাবিত করতে দেবেন না।
রায়ে আরও বলা হয়, বিচারক দলীয় স্বার্থ, জনবিক্ষোভ বা সমালোচনার ভয়ে প্রভাবিত হবেন না। তিনি পরিবার, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা বা অন্য কোনো সম্পর্ককে বিচারিক আচরণ বা রায়কে প্রভাবিত করতে দেবেন না। ব্যক্তিস্বার্থে তিনি বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব বিকিয়ে দেবেন না। বিচারকের সঙ্গে অমুকের ভালো সম্পর্ক রয়েছে—কারও সম্পর্কে এ রকম ধারণাও সৃষ্টি করতে দেবেন না।
রায়ে বলা হয়, কোনো মামলার বা বিচারাধীন বিষয়ের সারবত্তা নিয়ে বিচারক জনসমক্ষে মন্তব্য করবেন না। একজন বিচারক আদালতের কাজে বিলম্ব না করে দ্রুত শেষ করবেন। রায় দেওয়ার পর স্বাক্ষর দিতে কোনোভাবেই ছয় মাসের বেশি সময় নেওয়া যাবে না।
যদি যৌক্তিক কারণে কোনো মামলায় বিচারকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ওই বিচারক নিজেকে বিচারকাজ থেকে সরিয়ে নেবেন। কোনো মামলায় বিচারক পূর্বে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন, সেখান থেকেও তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবেন। বিচারক অতীতে যাঁর সঙ্গে প্র্যাকটিস করেছেন, তাঁর কাছে থাকা সেই সময়কার মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও এবং যেসব মামলায় তিনি সাক্ষী ছিলেন, সেখান থেকেও তিনি নিজেকে সরিয়ে নেবেন।
রায়ে বলা হয়, যদি ব্যক্তিগতভাবে বা জিম্মাদার হিসেবে বিচারক, তাঁর স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানদের কোনো অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে বা তাঁরা মামলায় পক্ষ থাকে বা অন্য কোনো স্বার্থ থাকে, যা মামলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তাহলে বিচারক সে মামলার শুনানি করবেন না। প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে বিচারক নিজে বা অন্য কারও সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হবেন না। দেশে বা বিদেশে একজন বিচারক কখনোই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হবেন না।
রায়ে বলা হয়, বিচারকের পরিবারের কোনো সদস্য যদি আইনজীবী হন, তাহলে ওই আইনজীবী কোনোভাবে বিচারকের বাসায় পেশাগত কাজ পরিচালনা যেমন ব্যক্তিগত চেম্বার করতে পারবেন না। আরও বলা হয়, বিচারক বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য কারও কাছ থেকে বিচারিক ক্ষমতার বিনিময়ে উপহার, অনুরোধ, ঋণ বা সুবিধা চাইতে পারবেন না। তিনি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবেন না। প্রধান বিচারপতি চাইলে একজন বিচারক তাঁর সম্পদ ও দায়ের হিসাব দাখিল করবেন।
ষোড়শ সংশোধনীর পূর্বাপর
ষোড়শ সংশোধনী বিলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়। এতে বলা হয়েছিল, ‘প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’ এতে বলা হয়, কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবে। সেই আইন আর হয়নি।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। পরে ১৯৭৭ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়। তাঁর সময়েই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে স্থান পায়। ২০১০ সালে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে অনুমোদন করেন। ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনা হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রেখে দেওয়া হয়। সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনী আনা হলে তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ দেওয়া হয়।
রিট আবেদনকারী আইনজীবীদের কৌঁসুলি মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করা হয়েছে। ফলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরল। এখন সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অদক্ষতার কোনো অভিযোগ উঠলে তাঁকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারণ করা যাবে। এ রায়ের মাধ্যমে জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হবে।