২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সীমান্ত হত্যা কমেনি করোনাকালেও

বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত
ফাইল ছবি

চার দিনের সীমান্ত সম্মেলনে যোগ দিতে গত বুধবার দুপুরে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) প্রতিনিধিদল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছিল। একই সময় দিনাজপুরের বিরল সীমান্তে পড়ে ছিল এক বাংলাদেশির লাশ। নিহত জাহাঙ্গীর আলম বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ ছিলেন। তাঁর গলিত লাশটি ছিল বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৫০০ গজ দূরে ভারতীয় সীমান্তের গোবরা বিলপাড়ে।

পতাকা বৈঠকের পর বুধবার বিকেলেই জাহাঙ্গীরের লাশ দেশে আনা হয়। পরিবারের অভিযোগ, বিএসএফের গুলি বা নির্যাতনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

শুধু দিনাজপুরের জাহাঙ্গীর আলমই নন, চলতি বছরের সাড়ে আট মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩৯ বাংলাদেশির। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে বিএসএফ সদস্যদের গুলিতে। পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে বিএসএফ সদস্যদের শারীরিক নির্যাতনের পর। আর সর্বশেষ জাহাঙ্গীর আলমসহ দুজনের মৃত্যুর ধরণ জানা যায়নি। গত বছর এই সময় (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সীমান্তে বিএসএফের গুলি বা নির্যাতনে মারা গিয়েছিলেন ২৮ জন বাংলাদেশি। নয়টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আসক এই পরিসংখ্যান প্রস্তুত করে থাকে।

চলতি বছরের মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ভারত লকডাউনের পথে হাঁটে। বাংলাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। মার্চ মাসে সীমান্তে হত্যা নেমে গিয়েছিল শূন্যের কোঠায়। কিন্তু পরের মাসেই বিএসএফ তিন বাংলাদেশিকে হত্যা করে। এরপর মে মাসে একজন, জুনে সাত, জুলাইয়ে তিন, আগস্টে পাঁচ ও চলতি সেপ্টেম্বরে গতকাল পর্যন্ত চারজন মারা গেছেন। সব মিলে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর এই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ২১।

এমনি প্রেক্ষাপটে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বিএসএফের মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন। চার দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল এবং বিএসএফ মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানার নেতৃত্বে ছয় সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করছেন।

বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলোচনার একটি মুখ্য বিষয় হচ্ছে সীমান্ত হত্যা। আমাদের অবস্থান একই, ডোন্ট কিল, ডোন্ট শুট।’ তিনি বলেন, ‘সীমান্ত হত্যার পেছনে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। এটি বন্ধে আমাদেরও কিছু করণীয় আছে। সীমান্ত এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে বিজিবিও কাজ করছে।’

১১ বছরে ৫২২ মৃত্যু

আসকের তথ্য বলছে, ২০০৯ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত সীমান্তে ৫২২ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বিএসএফ সদস্যদের গুলিতে। আর ১৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বিএসএফ সদস্যদের শারীরিক নির্যাতনের পর। আসকের এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৫ সালের পর থেকে মাঝের তিন বছর সীমান্ত হত্যা কমতে থাকলেও ২০১৯ সালে হঠাৎ তা বেড়ে যায়। এই ধারা এ বছরও অব্যাহত আছে।

চলতি মাসেই চার হত্যা

গত বুধবার দিনাজপুরের বিরল সীমান্তে জাহাঙ্গীর আলমের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। এ ছাড়া এই মাসে বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের গুলিতে আরও তিন বাংলাদেশি নিহত হন। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের পাখিউড়া সীমান্তে ৩ সেপ্টেম্বর বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ছবিল উদ্দিন (৩৫) নামের এক বাংলাদেশি। ৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তবর্তী এলাকায় বিএসএফের গুলিতে মো. বাদশাহ (২৭) নামের এক যুবক নিহত হন। রাতভর তাঁর লাশ সীমান্তেই পড়ে ছিল। সকালে বিএসএফ সদস্যরা সেই লাশ নিয়ে যান। গতকাল পর্যন্ত সেই লাশ ফেরত দেওয়া হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হন শরিফুল ইসলাম (৩০) নামের এক বাংলাদেশি জেলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকে পৃথিবীর কোনো আইনই সমর্থন করে না। সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ—যারা এসব ঘটাচ্ছে, তারা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। বিএসএফ আত্মরক্ষার কথা বললেও অস্ত্র হাতে কোনো বাংলাদেশি মারা যাওয়ার নজির এখন পর্যন্ত নেই। কেউ সীমান্ত অতিক্রম করে থাকলে তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হোক। গুলি করে মারার এখতিয়ার কারও নেই।

বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকে পৃথিবীর কোনো আইনই সমর্থন করে না। সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ—যারা এসব ঘটাচ্ছে, তারা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক