সিলেটে মুগ্ধতা ছড়ালেন লেখক সমরেশ মজুমদার
নানা বয়সী কয়েক শ মানুষ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই ছিল বেশি। সবাই এসেছেন কলকাতার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের কথা শুনতে। সবাই তন্ময় হয়ে লেখকের মুখ থেকেই শুনলেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতার কথা।
গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টায় ছিল সমরেশ মজুমদারকে ঘিরে এ অনুষ্ঠান। সিলেট শহরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার গোল্ডেন সিটি কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত গ্রন্থবিপণি বাতিঘরে ‘বই প্রকাশের গল্প’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠান হয়। এর আয়োজকও ছিল বাতিঘর। অনুষ্ঠানে বাতিঘর থেকে লেখকের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস অপরিচিত জীবনযাপন এবং বাদল সৈয়দের জন্মজয় বই দুটির মোড়ক উন্মোচন হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ।
দুটি পর্বে অনুষ্ঠানটি বিভক্ত ছিল। প্রথম পর্বে সমরেশ মজুমদার তাঁর শৈশবের বিভিন্ন ঘটনা এবং জনপ্রিয় উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, সাতকাহন, গর্ভধারিণীসহ তাঁর লেখালেখির বিষয়ে কথা বলেন। দ্বিতীয় পর্বে তিনি পাঠকদের লিখিত প্রশ্নের জবাব দেন। পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন সুমনকুমার দাশ। সবশেষে সমরেশ মজুমদারের প্রকাশিত উপন্যাসটির আগাম বুকিং দেওয়া পাঠকদের মধ্যে নির্বাচিত ১৫ জনের হাতে লেখক অটোগ্রাফসহ বই তুলে দেন।
বক্তৃতাপর্বের শুরুতেই সমরেশ মজুমদার সিলেটকে তাঁর জন্মভূমির সঙ্গে তুলনা করলেন। বলেন, ‘সিলেটে এসে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি। কারণ, উত্তরবঙ্গের যে চা-বাগানে আমার দীর্ঘ সময় কেটেছে, ঠিক সেই জায়গার মতোই সিলেট। সেই চা-বাগান, সেই মাটি। আমি যখন বিমানবন্দর থেকে আসছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, সিলেটের সঙ্গে ভারতের উত্তরবঙ্গের সেই চা-বাগানের ও এর আশপাশের এলাকার অনেক মিল রয়েছে।’
বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিক আরও বলেন, ‘মঞ্চনাটকের প্রতি খুব টান ছিল। প্রথম গল্পও লিখি চিত্রনাট্য রচনার জন্য। পরে এই গল্পটি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সম্মানী বাবদ ১৫ টাকা পাই। সেই টাকা দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে কফি খাই। এরপর এই খাওয়ার লোভে বন্ধুরা লেখার জন্য তাগিদ দেন। এভাবেই সাহিত্যজগতে প্রবেশ। মূলত অভিনয় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হলাম লেখক। লেখালেখি শুরুর ৫২ বছর হয়ে গেল। এত বছর ধরে লিখে আনন্দ পাচ্ছি।’
পাঠকদের প্রশ্নের উত্তরে সমরেশ মজুমদার প্রেম, ভালোবাসা, বিপ্লব, সাম্যবাদ নিয়ে কথা বলেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনাটুকুও। ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। একদিন উনার বাসায় দাওয়াত দেন। চা খাচ্ছি, এমন সময় শেখ হাসিনা বলে উঠলেন, আপনি তো একজন সরকারি কর্মকর্তার মেয়েকে নষ্ট করেছেন। আমি আশ্চর্য হলাম। আবারও জিজ্ঞেস করলাম, আমি নষ্ট করেছি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আপনার ‘গর্ভধারিণী’ বই পড়ে ওই সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে। কারণ সে জয়িতা হতে চায়। মেয়েটিকে এখন তার বাবা-মা বাসায় বন্দী করে রেখেছে।’
সমরেশ মজুমদার পরে গিয়েছিলেন মেয়েটির বাসায়। বাসায় গিয়ে যখন বললেন, তিনি সমরেশ মজুমদার, তখন মেয়েটির মা খুশিও হলেন, রাগও করলেন। রাগ করে বলেছিলেন, ‘আপনি আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন।’ তখন সমরেশ মজুমদারেরও খারাপ লেগেছিল। শেষে ওই নারী তাঁর মেয়েকে ডেকে বললেন, সমরেশ মজুমদার এসেছেন। মেয়েটি প্রথমে বিশ্বাস করেনি, কক্ষের দরজাও খুলছিল না। অনেক বলার পর দরজা খোলে।
অনুষ্ঠানে সমরেশ মজুমদার স্মৃতিচারণা করেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের। এ ছাড়া পাঠকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলা সাহিত্যের আরও দুই দিকপাল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে নিয়েও কথা বলেন।
বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ সূচনা বক্তৃতায় বলেন, ‘বাতিঘর কেবল ব্যবসার প্রতিষ্ঠান নয়। আমরা পাঠকদের জন্যও কিছু করতে চাই। সিলেটে সমরেশ মজুমদার এসে তাঁর জন্মভূমির অনুভূতি পেয়েছেন, এটাই আমাদের সার্থকতা।’ দেশ–বিদেশের প্রখ্যাত লেখকদের নিয়ে বাতিঘরের এমন আয়োজন অব্যাহত থাকবে বলে বক্তৃতায় তিনি জানিয়েছেন।