সালেকের বোঝা যেভাবে জাহালমের ঘাড়ে
আবু সালেকের ব্যাংক হিসাব খোলার ফরমে থাকা ছবি ও সংযুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা যান ২০১৪ সালে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের গুনিপাড়ায়। গ্রামের কয়েকজন লোক এই ছবি দেখে বলেন, লোকটির নাম জাহালম।
এরই সুবাদে তদন্তকারীদের কাছে সালেক হয়ে যান জাহালম, জাহালম হয়ে যান সালেক—দুই নাম, একই লোক। ব্র্যাক ব্যাংকের সেই কর্মকর্তা দুদকের ২৬টি মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জাহালমকেই মামলার আসামি সালেক বলে চিহ্নিত করেন। তবে তিনি একা নন। দুজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ব্যাংকের একাধিক গ্রাহক এবং জাহালম যে পাটকলে কাজ করতেন, তার ব্যবস্থাপকও একই কাজ করেন।
আর এভাবেই সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির মামলায় ফেঁসে যান নিরীহ জাহালম। এ সুযোগে জালিয়াতির টাকার ভাগ নিয়ে গা ঢাকা দেন জালিয়াতির বড় হোতা আবু সালেক। তিনি বিদেশে পালিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
সালেক ২০১০ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র, টিআইএন ও ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে স্বনামে একাধিক ব্যাংকে পাঁচটি হিসাব খুলেছিলেন। আর গোলাম মর্তুজা নামে খুলেছিলেন আরও আটটি ব্যাংক হিসাব, ব্যাংক কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। দুদকের কর্মকর্তারাও ভুলটা ধরতে পারেন না। ভুল লোককে ফাঁসিয়ে দেন।
গত বছর মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে আসল আবু সালেকের ঠিকানা জানা যায়। কাগজপত্রে দেখা যায়, সালেকের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের সিংগিয়া গ্রামে। সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব খোলার ফরমে তিনি ঠিকানা দেন টাঙ্গাইলের নাগরপুরের গুনিপাড়া গ্রামের। সেই হিসাব খুলতে তাঁকে সহায়তা করেন ওই ব্যাংকের কর্মচারী মইনুল হক। মইনুলের বাড়িও টাঙ্গাইলের নাগরপুরের সিংজোড়া গ্রামে। জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এই মইনুল।
মইনুল হকের খোঁজে টাঙ্গাইলে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গেলে তাঁর মা শেফালি বেগম বলেন, মইনুল কোথায় আছে তা তিনি জানেন না। এদিকে সোনালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখার তৎকালীন কর্মকর্তা বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী বলছেন, মইনুল ছিলেন ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী। তাঁর একার পক্ষে এত বড় জালিয়াতি করা অসম্ভব। একই মত দেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ফারহানা আলী।
জাহালম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। জেল খাটেন পুরো তিন বছর। গত ২৮ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে হাইকোর্টের আদেশে জাহালম ৩ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান।
জাহালমকে যেভাবে সালেক বানানো হয়
জাহালমের গ্রামের বাড়িতে গেলে তাঁর বড় ভাই শাহানূর জানান, কয়েক বছর আগে ব্র্যাক ব্যাংক কর্মকর্তা নাজিউর রহমান তাঁর ভাই জাহালমের ঠিকানা নেন। এরপর দুই সপ্তাহ পরই দুদকের চিঠি আসে।
জানতে চাইলে ব্যাংক কর্মকর্তা নাজিউর রহমান বলেন, তাঁর সঙ্গে আসা ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা ফয়সাল কায়েস সেই ঠিকানা নিয়ে যান। এই ফয়সাল ভুয়া হিসাব খোলার সময় সালেককে শনাক্ত করেছিলেন। গোলাম মর্তুজা নামে এই হিসাব খোলেন সালেক। ফয়সাল এখন বলছেন, গ্রামের লোকজন তাঁকে বলেছিলেন জাহালমই সালেক। এটা ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল না।
নাগরপুরের ধুবড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান সালেকের ছবি দেখানো হলে দুদকের কাছে জবানবন্দি দেন, তাঁর নাম জাহালম। অবশ্য প্রথম আলোর কাছে এ কথা তিনি অস্বীকার করেন।
সলিমাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম মন্টুকেও সালেকের ছবি দেখালে জাহালম বলে শনাক্ত করেন। জাহালমের কর্মস্থল বাংলাদেশ জুট মিলসের কর্মকর্তা খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামও এমনটাই করেন।
সোনালী ব্যাংকের হিসাব খোলার ফরমে সালেকের শনাক্তকারী ছিলেন সহিদুল ইসলাম। তিনি দুদককে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের মইনুল হক ওই সালেককে খালাতো ভাই বলে পরিচয় দেন। আমি সালেকের পরিচয়দানকারী হই। দুদকে সালেককে শনাক্ত করি। তাঁর নাম জাহালম।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন গত রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দুদকে জাহালম হাজির হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাঁকে সালেক হিসেবে চিহ্নিত করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এমন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আবার জিজ্ঞাসাবাদ করলে ওই সাক্ষীরা জানান, ছবির সঙ্গে মিল থাকায় জাহালমকে তাঁরা আবু সালেক মর্মে শনাক্ত করেছেন। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে বিভ্রান্ত হয়ে জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কে এই সালেক
আদালতকে দুদক প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, পঞ্চগড়ে সালেকের ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে। তা এখন বন্ধ। সালেক পঞ্চগড়ে ৭৫ শতক জমি কিনেছেন।
আবু সালেককে চেনেন বালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর এ আলম ছিদ্দিকী। তিনি বলেন, সালেকের বাবা কুদ্দুস একজন কৃষক। কয়েক বছরের ব্যবধানে এলাকায় বাড়ি বানিয়েছেন সালেক। জমিও কিনেছেন।
নূর এ আলম জানান, বছর দশেক আগে ছাগল চুরির অভিযোগে সালেকের বিচার তিনি করেছিলেন। তাঁর ধারণা, সালেক ভারতে পালিয়ে গেছেন।
জালিয়াতিতে আরও কারা
এই জালিয়াতির ঘটনায় সালেকের নাম বড় হয়ে এলেও সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির সঙ্গে আরও সাতজন জড়িত। তাঁদের মধ্যে আছেন পাঁচজন ব্যবসায়ী ও দুজন ব্যাংক কর্মচারী-কর্মকর্তা। তাঁদের একজন ব্যাংকের কর্মচারী মইনুল হক মামলার জবানবন্দিতে বলেন, ‘ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব ও অন্য একজন কর্মকর্তা আমাকে যা করতে বলেছেন, তা-ই করেছি।’
সোনালী ব্যাংকের এই জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হলে ২০১০ সালে মতিঝিল থানায় মামলা হয়। ডিবির তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের কর্মচারী মইনুল হক ও সাগর আহম্মেদকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। দুজনই আদালতে জবানবন্দি দেন। পরে মামলা যায় দুদকে। এজাহারে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা আজিজুল, নিজাম উদ্দিন ও লুৎফর রহমানের নাম ছিল। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁরা অব্যাহতি পান। মইনুল সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাতে সহায়তা করেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।
আরও পড়ুন: