সাদুল্যাপুরের ধাপেরহাটে সামাজিক দূরত্ব মানেন না কেউ
পুলিশের মাইকিং শুনেছেন সোলায়মান আলী। তাতে চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতির বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অতি জরুরি দরকার ছাড়া কেউ যেন বাড়ির বাইরে বের না হন।
তবু ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছেন সোলায়মান আলী। গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার এই বাসিন্দা বললেন, ‘বাইর হলে করোনা হবে। মানুষ মরবে। কিনতো না আসি কি করমো? পেটোত খিদে। খিদে তো আর করোনা মানে না।’
আজ মঙ্গলবার উপজেলার ধাপেরহাট বাজারে সোলায়মান আলীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বাজারটি সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নে পড়েছে। পেশায় দিনমজুর সোলায়মান আলীর বাড়ি ধাপেরহাট গ্রামে। জীবনের ঝুঁকি জেনেও জীবিকার টানে তাঁর মতো অনেকেই এসেছিলেন এই বাজারে। এতে সামাজিক দূরত্ব বিঘ্নিত হওয়ায় করোনার বিস্তার ঘটার ঝুঁকি বাড়ছে।
একই বাজারে আসা ধাপেরহাট ইউনিয়নের তিলকপাড়া গ্রামের রিকশাচালক বাবলু মিয়া বললেন, ‘করোনার ভয় করি নাব (লাভ) কী? এ্যাকসা (রিকশা) চলেয়া পাঁচজনের সংসার চালাছি। একন করোনার জন্নে এ্যাকসা চালান বনদো। কিনতো খাওয়ান তো আর বনদো করা যায় না। আচকে মানষের কাচে ৩০০ টেকা দ্যানা করি বাজারোত আচ্চি।’
একই গ্রামের কৃষক জোব্বার মিয়া বলেন, ‘করোনার কতা পোত্তেকদিন টেলিভিশনত দেকি। খুব খারাপ ওগ (রোগ)। যাগ ধরে তাই মরি যায়। হামারঘরোকও ভয় নাগে। কিনতো কি করমো? হামরা গেরোসতো মানুষ। আবাদের ভাত খাই। একনা নুন, ত্যাল না কিনলে সে ভাত খামো ক্যামন করি। তাই মনোত ভয় নিয়া বাজারোত আচ্চি।’
আজ ধাপেরহাট বাজার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কেউ সামাজিক দূরত্ব মানছে না। লোকজন গাদাগাদি করে কেনাকাটা করছেন। বেশির ভাগ দোকানি ও ক্রেতার মুখে মাস্ক নেই। বাজারে যেন ক্রেতা-বিক্রেতার মিলনমেলা। চায়ের দোকানে মানুষ গাঁ ঘেঁষে বসে গল্পগুজব করছেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই বাজারে বেচাকেনা চলে।
ধাপেরহাট গ্রামের স্কুলশিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে সবাইকে বাড়িতে থাকতে বলা হয়। জেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। তারপরও গ্রামগঞ্জের মানুষ বিষয়টির কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁরা অবাধে হাটবাজারে যাচ্ছেন। ফলে সবাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।
একই গ্রামের সংস্কৃতিকর্মী মকবুল হোসেন বলেন, সাধারণ ছুটি শুরুর পর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় কর্মরত অনেকে ধাপেরহাটে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন। তাঁরা সরকারের নির্দেশনা মেনে বাড়িতে থাকছেন না। হাটবাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সামাজিক দূরত্ব রাখার নির্দেশনাও মানছেন না। গাদাগাদি করে কেনাকাটা করছেন। ফলে করোনার বিস্তার ঘটার ঝুঁকি বেড়েছে।
ধাপেরহাটের পার্শ্ববর্তী নিচপাড়া গ্রামের চাকরিজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, শহরাঞ্চলে বেশির ভাগ মানুষই সরকারের নির্দেশনা মানছেন। তবে গ্রামাঞ্চলে বলতে গেলে কেউই তা মানছেন না। প্রশাসনের লোকজন প্রতিদিন এসে ধাপেরহাট বাজার ফাঁকা করে দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা চলে যাওয়ার পর আবারও জটলা লেগে যাচ্ছে। আসলে গ্রামাঞ্চলে সরকারিভাবে তেমন প্রচারণা নেই। ফলে গ্রামের মানুষ বিষয়টির গুরুত্ব তেমন বুঝতে পারছেন না।
সাদুল্যাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ রানা বলেন, প্রতিদিন স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশ করোনাভাইরাস–বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। তারপরও মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। অবাধে হাটবাজারে যাচ্ছেন। জনসমাগম বন্ধ করতে তৎপরতা আরও জোরদার করা হবে বলে জানান তিনি।
সাদুল্যাপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাহরিয়া খান বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রতিদিন মাইকিং করে দোকানপাট বন্ধ রাখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই তা মানছেন না। নিজেদের সুরক্ষার জন্যই মানুষজনকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ যাতে ঘর থেকে বের বের না হন, সে জন্য প্রশাসনের পক্ষে মাইকিং চলছে। সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ টহল দিচ্ছে। সারা জেলায় ১৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চলছে। প্রয়োজনে এসব তৎপরতা আরও বাড়ানো হবে।