সাত নদীর প্রাণ যায় যায়
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি/ চিক চিক করে বালি, কোথা নাই কাদা...।’
হাঁটুজল দূরের কথা, কোথাও পানি নেই। নদীর বুকে তাই চিক চিক করছে তপ্ত বালু। বালুর বুক চিরে ছুটছে মহিষের গাড়ি। মাথায় ধানের আঁটি নিয়ে ছুটে চলেছেন কৃষক। ডাঙায় খুঁটিতে বাঁধা নৌকা ও ট্রলারের অলস সময় কাটছে। বৈশাখের তপ্ত এক দুপুরের এ দৃশ্য পুনর্ভবা নদীর; ভারত সীমান্তঘেঁষা নিতপুর এলাকার।
শুধু পুনর্ভবা নয়, নওগাঁর সাতটি নদনদীরই করুণ দশা এখন। পানিশূন্য হয়ে তারা মৃতপ্রায়। এর মধ্যে রয়েছে নাগর নদও, যাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ওই বিখ্যাত শিশুতোষ কবিতা। নদীগুলোর বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কবিগুরুর ওই পঙ্ক্তির আর মিল নেই।
আন্তসীমান্ত নদী পুনর্ভবা। ঠাকুরগাঁওয়ে উৎপত্তি হওয়ার পর দিনাজপুর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে নদীটি। এরপর নওগাঁর পোরশা উপজেলার নিতপুর হয়ে আবার বাংলাদেশে এসেছে। মোট দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার। বাংলাদেশে পড়েছে ৮০ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুম ছাড়া এর কোথাও পানিপ্রবাহ থাকে না।
গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিতপুর এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, পুনর্ভবার ওপার থেকে ঘাস কেটে সবে ফিরেছেন শামসুননাহার। নিতপুর বিহারি কলোনির এই বাসিন্দা বললেন, ‘বর্ষার সময় পুনর্ভবার পানিতে এলাকায় বন্যা হয়ে যায়। এ ছাড়া সারা বছর এমনই থাকে।’ ভারত একতরফাভাবে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করায় পুনর্ভবার এ দশা বলে মনে করেন এলাকাবাসী ও বিশেষজ্ঞরা।
একই কারণে প্রাণ ওষ্ঠাগত নওগাঁর প্রধান নদী আত্রাইয়েরও। ভারত থেকে এসে শিমুলতলী সীমানা পার হয়েই হারিয়ে ফেলেছে স্রোতোধারা। একটু দূরে রাঙামাটি এলাকায় জনা দুয়েক হাঁটুজল ভেঙে ওপার যাচ্ছেন। কেউ পার হচ্ছেন বাঁশের সাঁকো দিয়ে। সাঁকো পার হতে হতে ভগবানপুর এলাকার হাবিবুর রহমান বললেন, পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে নদী। পানি কম, তাই নৌকা চলে না। প্রায় ২৫ বছর ধরে এলাকাবাসী শুকনো মৌসুমে সাঁকো দিয়ে পারাপার হচ্ছে।
আত্রাইয়ে পানি নেই বলে শিব ও ফকিরনীরও দুঃখের শেষ নেই। শুকিয়ে কাঠ এই দুই শাখানদী। চৌবাড়িয়া এলাকায় শিবের তীর দখল করে চলছে চাষাবাদ। চৌবাড়িয়া বাজারের একজন পল্লিচিকিৎসক বললেন, ‘নদীর সীমানা কোথায় ছিল, আর প্রভাবশালীদের দখলের কারণে এখন কোথায় গেছে, তা মানচিত্র দেখলে বুঝতে পারবেন।’ ফকিরনীর উৎসমুখেই পানি নেই। মাঝে মাঝে পানি জমে আছে। হাতে টিনের বালতি নিয়ে সেই পানিতে গোসল করতে এসেছেন গোয়ালমান্দা গ্রামের গৃহবধূ ব্রজবালা। বললেন, ‘এই পান দিয়েই ভাত রাঁধি, বাবা। কলের পানিতে আয়রন (মরিচা) ওঠে। পানি শুকিয়ে গেলে খুব কষ্ট হয়। পুকুর, ডোবার পানি দিয়ে রান্না করতে হয়।’
নাগর, ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গারও একই দশা। কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত নাগর নদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে দখল-দূষণে ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গার যে প্রাণ যায় যায় অবস্থা, তা অগোচরেই রয়ে গেছে। নওগাঁ শহরের প্রবেশমুখে সেতুর কাছে তুলসীগঙ্গার চেহারা মরা খালের মতো। শহরের বর্জ্যরাশি এসে পড়ছে এখানে। দুপাশেই অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে চেপে ধরা হয়েছে নদীটি। নওগাঁ সদরের তাজনগর থেকে চণ্ডীপুর পর্যন্ত তুলসীগঙ্গার ১০ কিলোমিটার এখন বছরের আট-নয় মাসই গবাদিপশুর চারণভূমি। ১৯৮২ সালের পর তাজনগরে ক্রস ড্যাম দিয়ে নদীটির গতিপথ পরিবর্তন করে ছোট যমুনায় মিলিত করার ফলে এই অবস্থা হয়েছে।
ছোট যমুনায়ও বর্তমানে বর্ষা মৌসুম ছাড়া পানিপ্রবাহ থাকে না। বালু তোলা ও দখলের কারণে নদীটির নাব্যতা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্যে বছরের বেশির ভাগ সময় নদীর পানি নর্দমার মতো কালো থাকে।
নওগাঁর নদীগুলোর এই দুরবস্থার জন্য আরেকটি বিষয়কে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা—গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, নদীতে পানি না পেয়ে কৃষকেরা সেচের জন্য ক্রমেই গভীর নলকূপনির্ভর হচ্ছেন। এর ফলে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্তমানে ৬০-৭০ ফুটের আগে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র উন্নয়ন সংস্থা (বিডিও) এ অঞ্চলের পানি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে থাকে। তাদের হিসাবে, ২০০৩ সাল পর্যন্ত আগের ১৫ বছরে পানির সর্বনিম্ন স্তর ৯.৮১ থেকে ১১.৭৮ মিটারের মধ্যে ওঠানামা করে। ২০০৪ সালের পরের আট বছরে সেটা ছিল ১২.০৫ থেকে ২২.৩ মিটার।
নদীবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে না। মানুষ নদীকে শুকিয়ে ফেলছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, ৩০ বছর ধরে বোরো আবাদ করতে পাম্প দিয়ে নদীর পানি তুলে ফেলা হচ্ছে। নদী বাঁচাতে খনন করে প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে প্রতিটি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতায় আসতে হবে। নদীকে নদীর কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
পাউবো নওগাঁ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। তবে এটি তাঁদের হাতে নেই; রাষ্ট্রীয় নীতির বিষয়। আর নদী খনন খুবই ব্যয়বহুল প্রকল্প। সরকার বড় নদীগুলোতে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু করছে। সফল হলে ছোট নদীগুলোতেও শুরু হবে।