নির্যাতন, গ্রেপ্তার, মামলা
সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধের চেষ্টা
সাংবাদিক রোজিনার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ষষ্ঠ দিনের মতো গতকাল প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সাংবাদিকেরা। গতকাল শনিবার বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচিতে তাঁরা বলেছেন, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু আন্দোলন ভিন্ন খাতে নিতে নানা চক্রান্ত হচ্ছে। মুক্ত সাংবাদিকতার স্বার্থে ঐক্য ধরে রাখতে হবে।
রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে নিগ্রহ-নির্যাতন, তারপর মামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল টানা ষষ্ঠ দিনের মতো রাজধানীতে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রাঙ্গণে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেন ক্ষুব্ধ নারী সাংবাদিকেরা। জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংগঠন প্রেসক্লাবে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে।
এসব কর্মসূচি থেকে রোজিনা ইসলামের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি তাঁকে আটকে রেখে নিগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সব কালাকানুন বাতিলের দাবি জানানো হয়।
রোজিনা ইসলাম ১৭ মে পেশাগত কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে তাঁকে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে নিগ্রহ-নির্যাতন করা হয়। পরে তাঁকে শাহবাগ থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে তাঁর বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধিতে মামলা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর প্রতিবাদে ওই দিন থেকেই বিক্ষোভ করে আসছেন সাংবাদিকেরা। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, মানবাধিকারবিষয়ক দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন।
গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ প্রাঙ্গণে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেন ক্ষুব্ধ নারী সাংবাদিকেরা। তাঁরা রোজিনা ইসলামের মুক্তি, তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তাঁরা রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করারও দাবি জানান।
নারী সাংবাদিকদের এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতা ও গণমাধ্যমকর্মীরা সংহতি জানান।
বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া এ কর্মসূচিতে নারী সাংবাদিকেরা বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ‘আমার বোন রোজিনা, মুক্তি ছাড়া বুঝি না’, ‘সাংবাদিক জেলে কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ এমন নানা স্লোগান দেন।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক বলেন, ‘রোজিনা ইসলাম আমাদের সহকর্মী বোন। সচিবালয়ে তাঁর ওপর চরম নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা মর্মাহত, ক্ষুব্ধ। তীব্র নিন্দা জানাতে এবং অবিলম্বে রোজিনার মুক্তির দাবিতে সংহতি জানাতে এখানে এসেছি।’
কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, রোজিনা ইসলামের সঙ্গে প্রতিটি ঘটনায় প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। সংবিধানে বাক্স্বাধীনতা এবং আলাদাভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনেকগুলো আইন সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করেছে। সাংবাদিকেরা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়গুলো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। রোজিনার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি সংবিধানের চেতনা সমুন্নত রাখতে কালো আইনগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।
রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
সাংবাদিক নেতা শাহনাজ শারমীন বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে রোজিনা ইসলামের করা প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন নজির নেই। বরং যিনি প্রতিবেদন করলেন, তাঁকেই জেলে পাঠানো হলো।
প্রতীকী অনশনে সংহতি জানান প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘যে সংহতি জানাতে এসেছি, তা বোনের জন্য, এমনকি আমাদের নিজেদের জন্যও। বৃহত্তর কারণে এসেছি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এসেছি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি।’ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করার যে চক্রান্ত চলছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বলে মন্তব্য করেন আনিসুল হক।
কারাগার সাংবাদিকের জায়গা হতে পারে না
ক্ষুব্ধ নারী সাংবাদিকদের প্রতীকী অনশনে ডিআরইউর নারীবিষয়ক সম্পাদক রীতা নাহার বলেন, ‘রোজিনার শুধু জামিন নয়, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং তাঁকে নির্যাতন-নিগ্রহের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির পর আমরা বাড়ি ফিরব।’
সাংবাদিক দৌলত আক্তার সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, রোজিনা অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নেওয়া হয় থানায়। তিনি সেদিনের ঘটনা তদন্তে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান।
সাংবাদিক শামীমা দোলা বলেন, সঠিক সংবাদ তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকের জায়গা কারাগার হতে পারে না।
প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, সাংবাদিক পুলক ঘটক, শরিফা বুলবুল, এম এম জসীম, সাজিদা ইসলাম, রুমানা জামান, রাজনীন ফারজানা, ফারহানা তাহের, ফাহিমা আক্তার, ফারজানা প্রিয়দর্শিনী, আসমা আক্তার, নার্গিস জুঁই, মরিয়ম মনি, নজরুল ইসলাম, রিয়াদুল করিম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সদস্য কাজী সুফিয়া আখতার প্রমুখ।
আন্দোলন নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে
গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধনের আয়োজন করে সহসম্পাদকদের সংগঠন ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিল। এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা সংহতি জানান।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন, ‘আমরা আশা করি রোববার (আজ) রোজিনা ইসলামকে মুক্তি দেওয়া হবে। তা না হলে নো রিটার্ন হোম আন্দোলন শুরু করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি মামুন ফরাজী বলেন, সাংবাদিকদের এই পরিণতির মূলে নিজেদের মধ্যে বিভক্তি। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন ধারায় যে আন্দোলন চলছে, প্রতিটি শক্তিকে একটা মোহনায় নিয়ে আসতে হবে।
সাংবাদিক নেতা শহীদুল ইসলাম বলেন, যখন সারা দেশে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে সাংবাদিকেরা রাজপথে নেমে এসেছেন, সেই সময়ে এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আন্দোলন নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তিনি এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলার আহ্বান জানান।
আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসানের পরিচালনায় মানববন্ধন কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক নেতা ইলিয়াস খান, কুদ্দুস আফ্রাদ, আবদুল মজিদ, দীপ আজাদ, নুরুল আমিন, সাজ্জাদ আলম খান, কাদের গণি চৌধুরী, জান্নাতুল ফেরদৌস প্রমুখ। এ ছাড়া ডিআরইউ, বাংলাদেশ ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, ঢাকা সাংবাদিক পরিবার বহুমুখী সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধনে সংহতি জানায়।
বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কর্মসূচি
রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে গতকাল প্রেসক্লাবের সামনে গণফোরাম, বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা পৃথক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
গণফোরামের কর্মসূচিতে দলটির (একাংশ) মুখপাত্র সুব্রত চৌধুরী বলেন, রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে ছয় ঘণ্টা আটক রেখে আরেকটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। এই ঘটনা এটাই প্রমাণ করে দেশে কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে না।