গৌরবে সৌরভে
সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সিলেট
পাহাড়-নদী-হাওর প্রকৃতির সিলেট যেন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক অঞ্চল। সবুজ চা-বাগান, অবারিত বনভূমি, প্রাকৃতিক গ্যাস-তেল, বালু-পাথর, হাওরে ধান-মাছ এ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছে। যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস সূত্রে প্রবাসেও আছে সিলেট।
সিলেট আমার জন্মভূমি। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.)-সহ ৩৬০ আউলিয়া এই সিলেটের মাটিতে শায়িত। তাই সিলেটকে আমরা পুণ্যভূমি বলতে পছন্দ করি। এই মাটি থেকেই উৎসারিত হয়েছেন শ্রীচৈতন্য। এ মাটিরই সন্তান হাসন রাজা, শিতালং শাহ, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম প্রমুখের মতো বাউল গীতিকবি।
সিলেটে আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সম্প্রীতির এমন এক মেলবন্ধন আমরা দেখেছি, যার তুলনা হয় না। একবার ষাটের দশকের গোড়ার দিকে রথযাত্রায় রথের পেছনে যেতে যেতে আমার সঙ্গে থাকা আমার বোন পথ ভুলে হারিয়ে গিয়েছিল। আমি তো বাসায় চলে এলাম। কিন্তু কেন রথের মেলায় গেলাম, সে জন্য কোনো বকা খাইনি। কেন সে হারিয়ে গেল, সেটাই ছিল আমাদের জন্য বড় একটা চিন্তার বিষয়। সন্ধ্যার পরে তাকে কান্নারত অবস্থায় কিনব্রিজের নিচে পাওয়া যায়। তখন এ ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে আমরা সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান ভাবতাম না, সামাজিক অনুষ্ঠান মনে করতাম। একদিকে রথের মেলায় হিন্দু-মুসলমানের সমাগম, অন্যদিকে মহররমের লাঠিখেলায় ঈদগাহ ময়দানে—কি হিন্দু, কি মুসলমান—সব সম্প্রদায়ের মানুষ থাকতেন। সিলেটের মানুষ মূলত ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মের পরিশীলিত যে চর্চা, তার মধ্য দিয়েই আমরা উঠে এসেছি। এভাবে সিলেট সব সময় পুণ্যভূমি হিসেবে ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত ছিল, কিন্তু গোঁড়ামি ছিল না।
আমাদের শৈশব-কৈশোরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানও দেখেছি। মণিপুরি এবং তাঁদের কিছু উপজাতি যেমন ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ যাঁদের বলা হয়, তাঁরা বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন। এটি আমাদের ঐতিহ্যে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সিলেটের ‘নাগরীলিপি’ আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ভাষা গবেষকদের কাছে একটা কৌতূহলের বিষয়। এই প্রাচীন লিপি, যা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, সেটি নিয়ে এখনো অনেক দেশে গবেষণা হয়, ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়েছে। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনীতির বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। ভাষা আন্দোলনের সময় সিলেটেও আন্দোলন হয়েছে। যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু গৃহীত হয়েছিল, তখন এর বিরুদ্ধে সিলেট শহরে মিছিল হয়েছে। সেখানে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে নারীও ছিলেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সিলেটকে বিশেষ স্থান দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রয়াত সি আর দত্তসহ স্বাধীনতাসংগ্রামে অগণিত মুক্তিসেনার ভূমিকা আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। মাওলানা ভাসানী যখনই সিলেটে আসতেন, আমাদের বাড়িতে একবার অন্তত আসতেন। আমার বাবার বন্ধু ছিলেন তিনি। এসে প্রথমে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘চোঙ্গা পিঠা’ খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। তখন পঞ্চাশের দশক, এই যে খাবারদাবারে সিলেটের বিশেষত্ব—বিন্নি চাল, চোঙ্গা পিঠা, তারপর বাঁশ দিয়ে কুড়িলের রান্না ইত্যাদির ঐতিহ্যও ছিল দারুণ। এখনো সিলেটের মানুষ এমনকি প্রবাসে যাঁরা আছেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যগুলো ধরে রাখতে চেষ্টা করেন।
একটা সময় ছিল, যখন সিলেটের সন্তান প্রজ্ঞাবান আমলারা প্রশাসনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার, চা-শিল্প, প্রবাসীদের আয়—সব মিলিয়ে সিলেটের অবদান বাংলাদেশের অর্থনীতির একধরনের চালিকা শক্তি।
স্বাধীনতাসংগ্রামের পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্বে উঠে এলেন সিলেটেরই একজন কৃতী সন্তান, ফজলে হাসান আবেদ; যিনি পরবর্তী সময়ে ‘স্যার’ উপাধিও পেয়েছিলেন। পৃথিবীর বৃহত্তম এনজিও হিসেবে পরিচিত ব্র্যাকের জন্ম সিলেটে, সুনামগঞ্জের শাল্লায়। এভাবে সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সিলেটের অনেক কৃতী সন্তান দেশের জন্য সুনাম অর্জন করেছেন। অনেকেই সিলেট থেকে রাজনীতির অঙ্গনে, সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে—সব জায়গাতেই অবদান রেখেছেন, রেখে চলেছেন। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সিলেটের মণিপুরি নৃত্যই শুধু নয়, মণিপুরি তাঁতবস্ত্রও পৃথিবীব্যাপী স্থান করে নিয়েছে। আমি আগেই বলেছি, সংগীত, নৃত্য—সবকিছুতেই সিলেট দীর্ঘদিন অগ্রণী ভূমিকায় ছিল।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বা মাথাপিছু গড় আয়ের ক্ষেত্রে সিলেট মহানগরীগুলোর অন্যতম। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার পরে সিলেটের স্থান। কিন্তু সামাজিক উন্নয়নের সূচকে সিলেট ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। যেটাকে বলা হয় আঞ্চলিক একটা বৈষম্যের ব্যাপার, সিলেটে সেটা প্রকট। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ও বাল্যবিবাহের হার অন্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেটে বেশি। সাক্ষরতার হার কম। প্রধানত এই চারটি সামাজিক উন্নয়নের সূচকে সিলেট ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে আছে কয়েক বছর ধরে। এমনকি পাবলিক পরীক্ষায় পাসের ক্ষেত্রে, যেমন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় দেখা যায়, বেশির ভাগ সময় সিলেট পিছিয়ে
আমাদের পরিবাবের প্রায় সবাই ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই মুরারিচাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) প্রাক্তন শিক্ষার্থী। শতবর্ষী এই কলেজে আমার বাবা দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। সেই এমসি কলেজে যখন দেখি সন্ত্রাসীদের ঘৃণ্য থাবা, নারীর অবমাননা, তখন ঐতিহ্য হোঁচট খায়, মাথা হেঁট হয়ে যায়। সে কারণেই মনে হয়, যতই সৌরভে-গৌরবে সিলেটকে আমরা ওপরে তুলি, কিন্তু ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকারের’ মতো সিলেটের কিছু নেতিবাচক দিক উঠে আসছে—ক্রমাগতভাবে ইদানীং।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বা মাথাপিছু গড় আয়ের ক্ষেত্রে সিলেট মহানগরীগুলোর অন্যতম। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার পরে সিলেটের স্থান। কিন্তু সামাজিক উন্নয়নের সূচকে সিলেট ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। যেটাকে বলা হয় আঞ্চলিক একটা বৈষম্যের ব্যাপার, সিলেটে সেটা প্রকট। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ও বাল্যবিবাহের হার অন্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেটে বেশি। সাক্ষরতার হার কম। প্রধানত এই চারটি সামাজিক উন্নয়নের সূচকে সিলেট ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে আছে কয়েক বছর ধরে। এমনকি পাবলিক পরীক্ষায় পাসের ক্ষেত্রে, যেমন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় দেখা যায়, বেশির ভাগ সময় সিলেট পিছিয়ে।
সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য যা দেখেছি, তার অনেক বিষয় আমাদের কাছে খুবই গৌরবের, আবার কিছু বিষয় স্বকীয়তায় ভাস্বর। কেন সিলেটের মানুষ নিজেদের ‘সিলেটি’ বলছে, আবার বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ‘বেঙ্গলি’ বলছে? ব্রিটিশ শাসকেরা ১৮৭৪ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সিলেটকে বেঙ্গল প্রদেশ থেকে আলাদা করে আসামের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। সে জন্যই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ যখন এসেছিলেন সিলেট সফরে তখন বলেছিলেন, ‘বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হ’তে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি’। এটা লক্ষণীয় যে বেঙ্গল প্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়েও সিলেটিরা নিজেদের কখনো ‘অসমিয়া’ বলেননি। ‘সিলেটি’ বলেই নিজেদের পরিচিতি দিয়েছেন, স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী সিলেটিদের মধ্যে আলাদা একটা মেলবন্ধন আছে। বাঙালিদের মধ্যেও অবশ্য আছে, কোনো বাঙালির সঙ্গে আরেক বাঙালির বিদেশের কোনো শপিং মলে দেখা হলে তাকায়, কথা বলে, জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি বাংলাদেশের নাকি পশ্চিমবঙ্গের?’ কিন্তু সিলেট শুনলে শুধু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে না, বাড়ি যাওয়ার জন্যও আমন্ত্রণ জানাবে। আত্মীয় ছাড়াও এই আত্মার বন্ধন সিলেটিদের মধ্যে কী করে গড়ে উঠেছে, তার সুস্পষ্ট ধারণা আমার নেই। এটা এখনো আছে। আছে বলেই সম্ভবত সিলেট একমাত্র অঞ্চল, যার অধিবাসীরা পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় ‘বিশ্ব সিলেট সম্মেলন’ করেছে! ইতিহাস যতটুকু জানি, এর সূচনা হয়েছিল ১৯০৬ সালে, কলকাতায়। হবিগঞ্জ কিংবা সিলেটে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু বসবাস করছেন কলকাতায়, সে রকম কিছু গুণীজন সেই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এর অনেক পরে, ২০১৫ সালে ভারতের ‘দক্ষিণ কলকাতা সিলেট অ্যাসোসিয়েশনের’ আয়োজনে কলকাতায় ‘ইন্দো-বাংলা সম্মেলন’ হয়। এ রকম পৃথিবীর আর কোথাও, কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ২০১৭ সালে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন ঢাকায় এই সম্মেলন করেছে, সিলেটেও করেছে।
নিউইয়র্ক শহরে ‘বিশ্ব সিলেট সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন টরন্টোর উদ্যোগে ২০১৮ সালে টরন্টোতে হয়েছে। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় ‘সিলেট উৎসব’ হয়েছে। আমার সুযোগ হয়েছিল সেগুলোতে অংশ নেওয়ার। একদিকে যেমন রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নিয়ে আলাপ-আলোচনা সভা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সিলেট অঞ্চলের প্রথিতযশা শিল্পীরা।
গত বছর যখন সর্বশেষ কলকাতায় বিশ্ব সিলেট সম্মেলন হলো, সেখানে অতিথি ছিলেন আমাদের সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম, সাহিত্যিকদের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অনেকেই।
কিন্তু সম্প্রতি আমাদের মূল্যবোধের যে একটা অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি, সেটা সম্ভবত সামাজিক সূচকে যে আমরা পিছিয়ে গেছি, লেখাপড়ার দিক থেকে অথবা বাল্যবিবাহের হার বেশি ইত্যাদি কারণে। সিলেটে শিশু নির্যাতনও বাড়ছে, নারী নির্যাতন বাড়ছে। সারা দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়েছিল, যখন শিশু রাজনের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কী নৃশংসভাবে তাকে অত্যাচার করে হত্যা করা হলো, আবার ভিডিওতে ধারণ করা হলো, ভাইরাল হলো। মূল্যবোধের জায়গায় তখন প্রচণ্ড একটা নাড়া খেয়েছে। তারপরে খাদিজার ঘটনা, এমসি কলেজের সামনে কোপানো হলো তাকে।
অতি সম্প্রতি যে ঘটনা বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে, সেটাও মুরারিচাঁদ কলেজভিত্তিক। আরও আগে এই কলেজেই রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। এ ধরনের সন্ত্রাস সিলেটের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ভেতরে একজন নারী যেভাবে লাঞ্ছিত হলেন, তাঁকে যারা লাঞ্ছিত করল, তারা তো পালিয়ে গেল। আমাদের ভাগ্য ভালো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরতে পেরেছে। ভাগ্য ভালো যে আমাদের সরকারপ্রধান একটা কঠোর সিগন্যাল দিয়েছিলেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো সিলেটে হওয়া উচিত ছিল না, তবু ঘটে চলেছে ইদানীং। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হল পোড়ানো থেকে শুরু করে নারী লাঞ্ছনার যে ঘটনা, এগুলোতে আমাদের মূল্যবোধ হোঁচট খায়।
সিলেট অঞ্চলে পীর হাবিবুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সাইফুর রহমান, শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মতো রাজনীতিবিদ ছিলেন। এখনো আছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাঁরা তো একধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেছেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাঁরা ছিলেন না। সেই ঐতিহ্যগুলো আমরা হারাতে বসেছি।
সাধক হজরত শাহজালাল (রহ.)কে সম্মান জানানোর জন্য সারা দেশ থেকে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে মানুষ ছুটে আসে। যখন আমি এমসি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম, আমাদের পরীক্ষার আগে আমাদের বন্ধুবান্ধুবের কেউ কেউ হয়তো হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর দরগায় গিয়েছেন, কেউ হয়তো যাননি, কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের বন্ধুরা রীতিমতো মানত করে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর দরগায় যেতেন। এটার মানে দাঁড়ায়, যে সংস্কৃতিকে আমরা লালন করেছি, যে ঐতিহ্যকে আমরা ধারণ করেছি, সেটি এখন অপস্রিয়মাণ। একদিকে হাসন রাজা, অন্যদিকে রাধারমণ। একদিকে পীর হাবিবুর রহমান, অন্যদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই যে সব মানুষ উঠে এসেছিলেন—রাজনীতি, প্রশাসন, সামাজিক উন্নয়ন, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে কিন্তু কী করে যেন আমাদের সেই শাশ্বত সংস্কৃতি-ঐতিহ্য হারাতে বসেছি, কোনোভাবেই এটা হারাতে দেওয়া যাবে না।
সিলেটের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়, সেটা বিশ্বাস করি। আর এই জায়গা থেকেই বলতে চাই, আমাদের ধর্মভীরুতা আমাদের অন্তরে লালন করব সব সময়। যে ধর্মের মানুষই হই, অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হব। রাজনীতির ক্ষেত্রে ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিকে সম্মান করব, নিজেরটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব, কিন্তু অন্যকে হেয় করব না। এই জায়গায় যদি সিলেট পথ দেখাতে পারে আগের মতো, তাহলে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে।
● রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
অনুলিখন: সুমনকুমার দাশ