২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সবজিতে সতেজ বাংলাদেশ

দেশি বীজ থেকেই বেশির ভাগ সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো
দেশি বীজ থেকেই বেশির ভাগ সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

‘পটল বুনলে ফাল্গুনে।
ফল বাড়ে দ্বিগুণে॥
উঠান ভরা লাউ শসা
খনা বলে লক্ষ্মীর দশা॥’
খনার এই বিখ্যাত
বচনের সময়কাল কবে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে এই বচন থেকে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বাংলা অঞ্চলে সবজি চাষ সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। ৮০০ থেকে ১২০০ শতককে বলা হয় খনার সম্ভাব্য জন্মকাল। তার মানে এই দাঁড়ায়, ওই সময় থেকেই সবজি চাষ একটি জনপ্রিয় ফসল ছিল। আর গত এক যুগে সবজি চাষে তো বাংলাদেশে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও)।
একসময় ভালো স্বাদের সবজির জন্য শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। টমেটো, লাউ, কপি বা নানা পদের শাক শীতকাল ছাড়া বাজারে মিলতই না। গ্রীষ্মকাল ছিল সবজির আকালের সময়। গত এক যুগে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন প্রায় সারা বছরই ২০ থেকে ২৫ জাতের সবজি খেতে পারছে দেশের মানুষ। গত এক দশকে তুলনামূলকভাবে দেশে সব ধরনের সবজির দামও কমেছে। বিশেষ করে, নানা জাতের শাক এখন শুধু বাজারে নয়, অলিগলিতে ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছে।
দেশের প্রায় সর্বত্র সারা বছর ধরে এমন কোনো না কোনো সবজি উৎপন্ন হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আয়োজিত সবজি মেলা ২০১৬ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে আলুসহ প্রায় ১৫৬ প্রজাতির শাকসবজি উৎপন্ন হয়ে থাকে, তার মধ্যে ২৯টি প্রধান। এই তথ্য প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু সবজি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রবি মৌসুমে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে এবং খরিপ মৌসুমে প্রায় পৌনে চার লাখ হেক্টর জমিতে এসব সবজির আবাদ হচ্ছে। এই দুই মৌসুম মিলিয়ে যে সবজি উৎপন্ন হয়, তার পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন।
সম্প্রতিক বছরগুলোতে সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির এক আশাব্যঞ্জক চিত্র বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় উঠে এসেছে। যেমন সবজির আবাদি জমির হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ প্রথম, উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে তৃতীয়। সবজি উৎপাদনের এই ব্যাপক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের গড়ে প্রতিদিন প্রতিজনের সবজি খাওয়ার পরিমাণ সুষম খাদ্য গ্রহণের অনুমোদিত মাত্রা ২২৫ গ্রামের অর্ধেকেরও কম। আমরা যদি অনুমোদিত মাত্রায় সবজি খেতে চাই, তাহলে সবজি উৎপাদন ও খাওয়ার অভ্যাস প্রায় দ্বিগুণ করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা সবজি উৎপাদনে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, তাতে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, এ দেশে একসময় দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের স্বল্পতার মতোই সবজির ব্যাপক আকাল ছিল। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে আমরা দেখেছি ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক মাসে সবজির অভাবে দরিদ্র পরিবারগুলো বনে-বাদাড়ে কচুঘেঁচু, কলমিশাক, সুশনী শাক আহরণ করে সবজির চাহিদা মেটাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করত এখানকার অধিবাসীরা। চৈত্র-বৈশাখে প্রথম প্রথম বৃষ্টিপাত হলে গৃহস্থ পরিবারগুলো বাড়ির আঙিনায় ঝিঙে, চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, কুমড়ো, ডাঁটাশাক, নটে শাকের বীজ বুনত। তা থেকে যে সবজি উৎপাদিত হতো, তা দিয়ে কেবল কয়েক মাসের পারিবারিক চাহিদা মেটাত। মিষ্টিকুমড়া সংরক্ষণ করা হতো দুর্দিনের সঞ্চয় হিসেবে। শীতকালে বেগুন ছিল প্রধান সবজি। তার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয় পালংশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, লাউ প্রভৃতি। কোনো কোনো এলাকায় পটোল, উচ্ছে, ভালো জন্মাত। কিন্তু সচ্ছল কৃষক ছাড়া এসব সবজি কিনে খাওয়ার সামর্থ্য সাধারণ বা ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারগুলোর ছিল না।
আয়তনের দিক দিয়ে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে। অতীতেও যেমন সবজি উৎপাদনে আঞ্চলিক প্যাটার্ন ছিল, এখনো তা অক্ষুণ্ন আছে। যশোর, কুমিল্লা, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ কয়েকটি জেলায় সবজি উৎপাদনের বিপ্লব ঘটেছে, যা মাত্র চার দশক আগেও ছিল অভাবনীয়। পাহাড় ও উপকূলীয় অঞ্চলে সবজি চাষ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বাড়ির আঙিনা, বাঁধ, ঘেরের পাড়ে এমনকি মাছ চাষের জলাশয়গুলোর ওপর বাউনি দিয়ে লতানো সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। পাহাড়ে জুম পদ্ধতিতে এবং বসতভিটায় সবজি চাষের ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু হাওর আঞ্চলে সবজির ঘাটতি এখনো চোখে পড়ার মতো।
একসময় দেশের সবজিভান্ডার ছিল যশোর, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট এলাকায়। আশির দশকে ওই এলাকায় চিংড়ি চাষের ব্যাপক প্রসার হয়। ফসলের জমিতে লবণপানি ঢুকিয়ে সেখানে চিংড়ি চাষ হতে থাকে। চার-পাঁচ বছর ধরে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সেখানে শীতকালে ঘেরের মধ্যে সবজি চাষ হচ্ছে। আর ঘেরের পাড় ও আলজুড়ে সারা বছর লাউ, চালকুমড়া, ঝিঙের মতো সবজির চাষ বেড়ে গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলজুড়ে শীতকাল নদীর শুকিয়ে যাওয়া অংশে মিষ্টিকুমড়ার চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে।
এভাবে গত এক যুগে দেশের কৃষিজমির পরিমাণ বাড়েনি, তারপরও সবজির জমির পরিমাণ বাড়াচ্ছেন কৃষকেরা। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে, এই কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করে। জমির পাশের উঁচু স্থান, আল, বাড়ির উঠান, এমনকি টিনের চালাতেও এ দেশের কৃষকেরা সবজির চাষ করছেন। এমনও দেখা গেছে, ফলবাগান ও বাড়ি-রাস্তার পাশের উঁচু গাছের মধ্যেও মাচা করে সবজির চাষ করছেন অনেক কৃষক। ফলে মোট কৃষিজমির পরিমাণ কমলেও সবজি চাষের এলাকা বেড়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে সবজির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, ভোগও তেমনি বেড়েছে। গত এক যুগে দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি সবজি রপ্তানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা। গত এক বছরে শুধু সবজি রপ্তানি আয়ই বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে।

এক যুগে
মাথাপিছু সবজির
ভোগ বেড়েছে
২৫%

এক বছরে সবজির রপ্তানি আয় বেড়েছে
২৪%

দেশে উৎপাদিত বীজ
৯০%

মো. হামিদুর রহমান: কৃষিবিদ, সাবেক মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।