পদ্মা সেতু প্রকল্পে মূল সেতু নির্মাণকাজের প্রথম ধাপ পাইলিং। খরস্রোতা পদ্মায় এটি ছিল অন্যতম জটিল কাজ। ২০১৫ সালের ১ মার্চ পদ্মার পাড়ে ভোজ আয়োজন ও আতশবাজি ফুটিয়ে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ শুরু করে মূল সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)।
সেতুর পাইলের ওপর নির্মাণ করা হয় পিলার। এর ওপর বসানো হয় ইস্পাতের স্প্যান। পদ্মা সেতুতে স্প্যানের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে যানবাহন ও ট্রেন চলাচলের পথ। আরও ছোট-বড় কিছু কাজের শেষ পর্যায়ে পিচঢালাই দিয়ে সড়ক তৈরি করে যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয় সেতু। ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ শেষ হতে চলেছে।
উল্লেখ্য, মূল সেতুর কাজের জন্য ২০১৪ সালের নভেম্বরে এমবিইসিকে নিয়োগ দেয় সরকার। চুক্তি হয়েছিল ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায়। পরীক্ষামূলক পাইলিং শেষ করে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মূল পাইল বসানো শুরু হয়। ওই দিন সশরীর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে পাইলিং শেষ হয়।
পাইল বসানো যে কারণে কঠিন
মূল সেতুতে পাইল রয়েছে ২৬৪টি। নদীর ভেতরে ও দুই প্রান্তে সেতুর ৪০টি পিলারের নিচে পাইপের মতো দেখতে পাইলগুলো বসানো হয়েছে। নদীর পাইলগুলো ভেতরে ফাঁকা, ইস্পাতের তৈরি। প্রতিটি পাইলের ব্যাসার্ধ তিন মিটার। পুরুত্ব ৬২ মিলিমিটার। একেকটি পিলারের নিচে ছয় থেকে সাতটি পাইল বসানো হয়েছে। এই পাইল নদীর তলদেশের মাটি থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ দশমিক ৪৬ মিটার (প্রায় ৪১২ ফুট) গভীরে বসানো হয়েছে।
পাইল বসানোর উদ্দেশ্য সেতুর ভিত্তি শক্তিশালী করা, যাতে অধিক ভারে সেতু দেবে না যায়। সেতু বিভাগ বলছে, বিশ্বে আর কোনো সেতুতে পদ্মা সেতুর মতো গভীরতায় পাইল বসানোর প্রয়োজন হয়নি। পাইলগুলোর প্রতিটি ৮ হাজার ২৫০ টন ভার বহন করতে সক্ষম। প্রতিটি পিলার প্রায় ৫০ হাজার টন ভার বহন করতে পারবে। আর ৪ হাজার ডেড ওয়েট টনেজ (ডিডব্লিউটি) সক্ষমতার জাহাজের ধাক্কা সামলাতে পারবে এই পিলার।
এত বড় ও শক্তিশালী পাইল কীভাবে মাটির এত গভীরে পাঠানো হয়েছে, সেই কৌতূহল জাগতে পারে। জানা যাক পাইল বসানোর কাজে ব্যবহৃত পাঁচটি ‘হাইড্রোলিক হ্যামার’ সম্পর্কে, যা আসলে দৈত্যাকার হাতুড়ি। পদ্মা সেতুর জন্য আনা হাতুড়ির মধ্যে তিনটি জার্মানির কোম্পানি মেংক-এর। নেদারল্যান্ডসের আরএইচসি কোম্পানির কাছ থেকে আনা হয় বাকি দুটি হাতুড়ি। এসব হাতুড়ির ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৯০০ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কিলোজুল।
পদ্মা নদীর দুই প্রান্তে ডাঙায় আরও ৩২টি পাইল বসানো হয়েছে। তবে সেগুলো রড দিয়ে তৈরি করা হয়।
পাইল জটিলতায় দুই বছর
পদ্মা সেতুর পাইলিং শুরু হয়েছিল মাওয়া প্রান্তে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি পিলারের নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হবে। সেতুর ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নিচে তিনটি করে পাইল বসাতে গিয়ে নরম মাটির স্তর পাওয়া যায়। সাধারণত মাটির গভীরে যেখানে পাথর বা শক্ত মাটির স্তর পাওয়া যায়, সে পর্যন্ত গভীরতায় পাইলিং করা হয়। কিন্তু শুরুতে পরিকল্পনামতো গভীরতায় গিয়েও মাটি নরম পাওয়ায় পাইল বসানোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে মাওয়া প্রান্তে কাজ বন্ধ রেখে জাজিরা প্রান্তে পাইল বসানো শুরু হয়।
মাওয়ায় নরম মাটি পাওয়ার পর অন্য পাইলের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করে কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে দেখা যায়, আরও ১২টি পিলারের নিচে যেখানে পাইল শেষ করার কথা, সেখানে নরম মাটি রয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১৪টি পিলারের নিচে পাইলিং নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
এ সমস্যা সমাধানে যুক্তরাজ্যের কাউই নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বেশ কিছু বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। একটি পরামর্শ ছিল, কিছু পিলারের নিচে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়া হোক।
পাশাপাশি পিলারে গোড়ায় খাঁজ কাটা পাইল দিয়ে অতিমিহি সিমেন্টের মিশ্রণে নরম মাটি শক্ত করা হোক। প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং সরকার এই বিকল্প বেছে নেয়। মূল সেতুর ২২টি পিলারের প্রতিটির নিচে ৭টি করে পাইল বসানো হয়। ১৮টি পিলারের নিচে বসানো হয় ৬টি করে। আর দুই প্রান্তের দুটি পিলারে (রডের) পাইল বসানো হয় ১৬টি করে।
জটিলতার কারণে পাইল বসাতে দেরি হওয়ায় পিলারের কাজও পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ৩১ মার্চ সেতুর সব পিলারের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এর মাধ্যমে শেষ হয় সেতুর সাবস্ট্রাকচার বা নিচের অংশের কাজ।
সেতুতে সুপারস্ট্রাকচার বা মূল কাঠামোর কাজ হচ্ছে ইস্পাতের স্প্যান বসানো। পাইলের জটিলতার কারণে পিলার তৈরি যেমন পিছিয়ে যায়, তেমনি স্প্যান বসানোও কিছুটা জটিলতায় পড়ে। অবশ্য সব জটিলতা কাটিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হয়েছে।